বিচারে বিলম্ব কমিয়ে আনা নিছক প্রশাসনিক লক্ষ্য নয়, নৈতিক বাধ্যবাধকতা: প্রধান বিচারপতি
বিচারে বিলম্ব হ্রাস করা নিছক প্রশাসনিক লক্ষ্য নয়, বরং এটি নৈতিক বাধ্যতাবাধকতা বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একইসঙ্গে তিনি বলেছেন, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে আইনি সহায়তায় বিচারিক কার্যক্রম আরও সহজ করা হচ্ছে।
প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে শনিবার ‘বিচারিক স্বাধীনতা ও দক্ষতা’ শীর্ষক কনফারেন্সে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের সভাপতিত্বে এই কনফারেন্সে ইউএনডিপি বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ, নিম্ন আদালতের বিচারকবৃন্দ অংশ নেন।
১৯৭১ সালের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, তাদের আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীন জাতির ভিত্তি স্থাপন করেছিল। বিজয়ের এই মাস ডিসেম্বর তাদের অতুলনীয় সাহস এবং উৎসর্গের একটি শক্তিশালী অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের দৃঢ় চেতনাকেও স্মরণ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লব নিপীড়ন উৎখাত এবং ন্যায়বিচার, সাম্য ও মানবতা পুনরুদ্ধারের লড়াই।
সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসের এই সংজ্ঞায়িত মুহূর্তগুলো মনে করিয়ে দেয় যে ন্যায়বিচারের সন্ধান একটি ক্ষণস্থায়ী প্রচেষ্টা নয়; বরং একটি আজীবন প্রতিশ্রুতি, যা আমাদের বিচারিক মিশনের ভিত্তি তৈরি করে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সম্প্রতি একজন বিচারপ্রার্থী আপিল বিভাগ বেঞ্চের কাছে যান। ওই বিচারপ্রার্থী কাঁপা কণ্ঠে কথা বললেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিলম্বিত বিচারের কারণে ওই বিচারপ্রার্থী তার দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। তার কষ্ট দেখে আমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে আগামী মাসে তার মামলার শুনানি হবে। ওই বিচারপ্রার্থীর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, বিচারে বিলম্ব হ্রাস করা নিছক প্রশাসনিক লক্ষ্য নয়, বরং এটি নৈতিক বাধ্যতাবাধকতা। ন্যায়বিচার যাতে বিলম্বিত না হয় তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, গত ২১ সেপ্টেম্বর সারাদেশের বিচারকদের উপস্থিতিতে এক সভায় বিচার বিভাগীয় সংস্কারের জন্য একটি ব্যাপক রোডম্যাপ উন্মোচন করেছি। এই উদ্যোগটি আমাদের বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে এবং সততা ও দক্ষতার সঙ্গে জনগণের সেবা করার ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য আমার দৃষ্টিভঙ্গির একটি ভিত্তি।
তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করার জন্য আমার দৃঢ় প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে, আমি ক্ষমতার সত্যিকারের পৃথকীকরণের ভিত্তিস্থাপনের জন্য সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়েছি। আমি বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় তৈরির প্রক্রিয়া ঘোষণা করেছি এবং শুরু করেছি, যা বিচার বিভাগের প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। পাশাপাশি, আমি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং যোগ্যতা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কাউন্সিল গঠনে সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছি।
সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অবশ্যই দক্ষতার পরিপূরক হতে হবে। আমরা কেস ব্যাকলগ, বিলম্ব এবং পদ্ধতিগত অদক্ষতা দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন- যা উদ্ভাবন, পরিশ্রম ও দূরদর্শিতাকে একত্রিত করে। কেস ম্যানেজমেন্ট প্রসেসকে স্ট্রিমলাইন করার জন্য কাজ করছি। আদালতের কার্যক্রমকে আরও দক্ষ ও স্বচ্ছ করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। ডিজিটালাইজেশন আর বিলাসিতা নয়; এটি একটি প্রয়োজনীয়তা। আধুনিক সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তিকে একীভূত করার মাধ্যমে, বিলম্ব কমাতে, স্বচ্ছতা বাড়াতে এবং মামলাকারীদের আরও নির্বিঘ্ন সেবা প্রদানে আমরা বদ্ধপরিকর।
তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে ইউএনডিপি অনুঘটক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সক্ষমতা-নির্মাণ কর্মসূচি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বিচার বিভাগের অনন্য প্রয়োজন অনুসারে নীতিগত উন্নয়নে আরও সহায়তা করতে পারে ইউএনডিপি। সহযোগিতা বৃদ্ধি করে, উদ্ভাবনী সমাধান প্রদান করে এবং টেকসই বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইউএনডিপির সঙ্গে আমাদের উন্নয়ন অংশীদাররা সর্বাগ্রে চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে এবং একটি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমাদের ক্ষমতায়ন করতে পারে।’