বেসরকারি টিভি চ্যানেল গান বাংলার চেয়ারম্যান কৌশিক হোসেন তাপস নিজেকে পরিচয় দিতেন গায়ক, সুরকার। আবার কখনো সংগীত পরিচালক হিসেবে। তার প্রতিষ্ঠানে রাতভর চলত আড্ডা, গান ও নানা আয়োজন।
সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রীদের সেই আড্ডার মধ্যমণি হতেন তাপস ও তার স্ত্রী ফারজানা মুন্নী।
দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের কর্মচারী তাপস মূলত স্ত্রীর হাত ধরেই রাতারাতি একের পর এক সিঁড়ি টপকান। সামান্য একজন তবলা বাদক থেকে হয়ে ওঠেন সংস্কৃতি অঙ্গণের মিডিয়া মাফিয়া তাপস। মন্ত্রী ও আমলাদের খুশি রাখতে কথিত মডেল ও সুন্দরী নারী ছিলো তার হাতিয়ার। এতেই কোটিপতি বনে যান তাপস।
এক সময়ের মধ্যবিত্ত তাপস এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। লন্ডনে বিলাসবহুল বাড়ি ছাড়াও রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট।
জানা গেছে, দেশের সঙ্গীতাঙ্গণে তাপস একটি ‘রহস্যময়’ চরিত্রের নাম। একসময়ের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের কর্মচারী থেকে কয়েক বছরের ব্যবধানে নিজেই একটি চ্যানেলের মালিক বনে যান তিনি। এসবের পেছনে তার চতুরতা যেমন ছিল, একইভাবে ‘জাদুর কাঠি’র ব্যবহারও ছিল। স্ত্রীর হাত ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গান শুনিয়ে সেই প্রভাব আরও বাড়ান তাপস। গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের সব সংস্কৃতি অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব থাকত তার হাতে। যার মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন আয়োজিত লাল-সবুজের মহোৎসব, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান অন্যতম। সেখান কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
আর এসব কাজে অধিকাংশ সময়ই তাপস ব্যবহার করতেন তার জাদুর কাঠি ‘ফারজানা মুন্নি’ ও তার গান বাংলা চ্যানেলের নাম করে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন তরুণীদের। মুন্নির সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সখ্যতা, বিশেষ করে শেখ হাসিনার ‘আস্থাভাজন’ পরিচয় কাজে লাগানো ও বিদেশি তরুণীদের দিয়ে ‘মনোরঞ্জন’-এর ব্যবস্থা করা ছিল এই ধূর্ত মিডিয়া মাফিয়ার অন্যতম হাতিয়ার।
প্রশাসন ও মন্ত্রীদের ব্যবহার করে তাপস শুধু প্রভাব অর্জন করেন নি। তার এই প্রভাব ব্যবহার করে প্রতারণা করেছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের বহু মানুষের সঙ্গে। অনেকে লোক লজ্জার ভয়ে মুখ খুলতে চান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণ পরিচালক তাপসের প্রতারণা ও উত্থানের বিষয়ে বলেন, ‘তাপসকে আমি ২০০৮ সাল থেকে চিনি। সে একটা সময়ে কারওয়ান বাজারে একটি টেলিভিশনের তবলা বাদক ছিলো। তাপস অনেক চালক মানুষ। তার মূলত দুটি হাতিয়ার। একটি হলো মানুষকে কনভেন্স করা ও অপরটি হলো তার নারী সাপ্রাই। সে গানটা ভালো গাইতে পারে। ব্যাচ এতেই তার এতো ক্ষমতা অর্জন হয়েছে।’
অভিযোগ আছে, গান বাংলার নাম করে ইউক্রেন ও বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে নারী এনে তাদেরকে অনৈতিক কাজে লিপ্ত করতেন তাপস।এভাবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি, আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন তিনি। বয়সে বড় ফারজানা মুন্নিকে সন্তানসহ বিয়ে করেন তিনি। মুন্নিকে বিয়ের আগে তার বড় মেয়ে নাজিস আরমানকে প্রাইভেট পড়াতেন তাপস। সেই সূত্রে গড়ে ওঠে পরোকীয় প্রেম। যা একপর্যায়ে বিয়েতে গড়ায়। বিয়ের পর নিজেদেরকে মিডিয়ার ‘পাওয়ার কাপল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তাপস-মুন্নি। যেকোনো অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান থেকে সাংস্কৃতিক আয়োজন, সকল ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন এই দম্পতি।
২০২২ সালের মার্চে নিষেধাজ্ঞা ও দেশের ইসলামি দলগুলোর বিরোধীতা সত্ত্বেও প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নীল সিনেমার নায়িকা ও বর্তমানে বলিউড অভিনেত্রী সানি লিওনকে ঢাকা আনেন তাপস। সেসময় তথ্য মন্ত্রনালয় থেকে জানানো হয়েছিল, সানি লিওনের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু মেয়ের বিয়েতে এই বলিউড তারকাকে নাচাবেন বলে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই ঢাকায় সানি লিওনকে নিয়ে আসেন তাপস। ১৩ ঘণ্টার সফর শেষে কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই দেশ ছাড়েন অভিনেত্রী।
জানা গেছে, তাপসে স্ত্রী মুন্নীর আগের সংসারের মেয়ে নাজিস আরমান লন্ডনে বসবাস করেন। নাজিস আরমান কাজ করছেন পতিত সাবেক সরকার প্রধানের মেয়ে পুতুলের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থাকতে বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন তার মেয়ে। একটি সূত্র জানিয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কন্যার সঙ্গে বর্তমানে ভারতেই আছেন তাপসের কথিত মেয়ে নাজিস।
অভিযোগ রয়েছে, বিউটিশিয়ান স্ত্রী মুন্নী ও গান বাংলার তাপস মিলে বিপুল পরিমাণ টাকা লন্ডনে পাচার করেছেন। দেশের বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান আয়োজনে বিদেশি শিল্পী আনার নামে এই সব টাকা পাচার করেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেওয়া তাপস একটা সময়ে একটি টিভি চ্যানেলে কর্মচারী থাকলেও এখন অঢেল সম্পদের মালিক। বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি কেনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার বিনিয়োগ রয়েছে। যার দেখভাল করেন তার কথিত মেয়ে নাজিস আরমান ও তার স্বামী সালমান বেগ। মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে দিয়ে দেশ থেকে পাচার করা কোটি কোটি টাকার সম্পদ পাচার করেছেন তাপস।
বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা তাপসের লন্ডনের বাড়ির ছবি ও ঠিকানা এসেছে ভোরের পাতার কাছে।
জানা গেছে, কয়েক কোটি টাকা মূল্যে লন্ডনের অ্যাসেক্স এলাকার মেমোরিয়াল হাইটে তার একটি বহুতল বাসা রয়েছে। যেটি দেখাশোনা করেন তার মেয়ে নাজিস ও তার স্বামী। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরেও বিলাস বহুল ফ্ল্যাট রয়েছে।