ভারত যেসব প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে, সেগুলো নিজেদের প্রয়োজনেই দিয়েছে। যেসব সড়ক ও রেলপথ নিজেদের দরকার ছিল, সেগুলোতে বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে করিয়ে নিয়েছে। সেসব রাস্তার একমাত্র সুবিধাভোগী ভারতই। ভারতীয় ঋণ বাংলাদেশের তেমন কাজে লাগেনি। বরং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ঋণ নেওয়ায় চাপে পড়েছে সরকার।
অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসছে বলে জানা গেছে। আজ রবিবার দুপুর ১২টায় শ্বেতপত্র প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হবে। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে আগামীকাল ২ ডিসেম্বর।
সরকারের সচিব, ব্যবসায়ী এবং নাগরিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের সঙ্গে তিন মাস আলোচনা, পর্যালোচনা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের পর এসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছে অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনা পদ্ধতিই দুর্নীতির সহায়ক ছিল বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, গত ১৫ বছরে সরকার যেভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, সেই পদ্ধতিটিই ছিল দুর্নীতি ও অনিয়মকে উৎসাহিত করার। তাই এত বেশি দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে!
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ভারত তিনটি লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) মিলিয়ে বাংলাদেশকে মোট ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ছাড় হয়েছে মাত্র ১৮৬ কোটি ডলার। এ পর্যন্ত প্রথম এলওসির ৩৭ কোটি ডলারের মতো পরিশোধ করা হয়েছে। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক এই ঋণ দিচ্ছে। তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, জ্বালানি, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামো খাতে এ পর্যন্ত ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি শেষ হয়েছে।
চলমান রয়েছে আটটি প্রকল্প। বাকি প্রকল্পগুলো পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগ কিংবা প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির পর্যায়ে রয়েছে।
ইআরডির একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, গত ১৫ বছরে ভারত নিজেদের সুবিধার প্রকল্পগুলোতেই ঋণ দিয়েছে। ভারত প্রকল্পগুলোতে শুধু পণ্য দিয়েছে। ঋণের কোনো টাকা দেশে আসেনি। ঠিকাদারকে তাদের দেশেই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু এখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে। প্রকল্পগুলোতে ভারতের ঋণ ছাড়ে জটিলতা প্রকল্পগুলোতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করেছে। শুধু বন্ধুত্ব ধরে রাখার জন্যই তাদের থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রশাসন রাজনৈতিকভাবে জিম্মি ছিল। অর্থ লুটপাটের জন্য প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নেও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। রাজনীতির কাছে প্রশাসন জিম্মি ছিল, সেই জিম্মিদশা কাটানোর জন্য তাদের যৌথ কোনো উদ্যোগ ছিল না। তাদের মধ্যে কিছু সিনিয়র কর্মকর্তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। তাই সিনিয়র কর্মকর্তারা কিছু করার উদ্যোগ নেননি। এ ছাড়া সচিবদের মধ্যে সক্ষমতা ও সমন্বয়ের অভাব এবং সদিচ্ছা না থাকায় অনেক কিছুর পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ লুট করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প নেওয়া ও প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে উন্নয়নের রাজনৈতিক প্রভাবে সরকারি কর্মকর্তারা প্রভাবিত হয়েছেন। সেই প্রকল্প পরবর্তী সময়ে একাধিকবার সংশোধিত হয়েছে, অর্থায়নের পরিমাণ বেড়েছে, সময় বেড়েছে। যদি দেশের রাজনীতি ঠিক না থাকে, তাহলে আমলাতন্ত্র এখান থেকে মুক্ত হবে না। রাজনৈতিক জায়গাটায় গণতন্ত্র চর্চা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে সরকারি নথি ও বিভিন্ন বৈশ্বিক মডেল এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সময়স্বল্পতার কারণে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য নির্ধারণ করা যায়নি।
কিভাবে অর্থপাচার হয় এবং কিভাবে বন্ধ করা যায়, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে গত ২ নভেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানায়, ১৫ বছর ধরে প্রতিবছর দেশ থেকে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির তথ্য অনুযায়ী, কর ফাঁকি দিতে ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ভুল চালানের কারণে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ গড়ে প্রায় ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে।
সূত্র জানায়, কমিটি বেশ কিছু প্রকল্পের দুর্বলতা তুলে ধরেছে। এগুলো হলো—পদ্মা সেতু ও এই সেতুর রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কর্ণফুলী টানেল অন্যতম। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ ও কানাডার আদালতের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের বিষয়েও ত্রুটি তুলে ধরা হয়েছে। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা বা ৩.৫৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২.৪ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের দেওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে।
সূত্র বলছে, মোট সরকারি ঋণ, বিশেষ করে বিদেশি অর্থায়নে চলমান ২১৫টি প্রকল্পের আগামী চার বছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বিষয়টি প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটি বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি ব্যয় যৌক্তিককরণ, মন্দ ঋণ পরিস্থিতির উন্নতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনা জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছে।
গত আগস্ট মাসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, সংকোচনের পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এই হিসাবে বিদ্যুৎ খাতে গত ১৫ বছরে লুটপাটের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৯০ হাজার থেকে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দাবি করেছে, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ খাতে খরচ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা, যার বেশির ভাগই গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন কম্পানির ভাণ্ডারে। চলতি বছরের ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
সরকারপক্ষ থেকে জানানো হয়, শ্বেতপত্রে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিফলন থাকবে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’। কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন হস্তান্তর করবে বলে নির্দেশনা ছিল।