চলছে শীতের মৌসুম। সামনে বড়দিন। তারপর আসছে নতুন বছর। প্রতি বছর এই সময়টায় বাংলাদেশি পর্যটকের ভিড়ে গমগম করে কলকাতার নিউমার্কেট চত্বর। তবে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। নেই সেই চেনা দৃশ্য।
পরিসংখ্যান বলছে, তিন মাস ধরে ব্যবসায় প্রায় ৭০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দোকান ভাড়াও জোগাড় হচ্ছে না। বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছু দোকান। গ্রাহকের অভাবে ধুঁকছে আবাসিক হোটেল। প্রভাব পড়েছে মুদ্রাবিনিময় কেন্দ্রে। মেডিকেল সেক্টরে। সংকটে পরিবহন পরিষেবাও।
ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, চলমান অবস্থা আরও কয়েক বছর থাকলে এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র অর্থনীতি (মাইক্রো-ইকোনমি) ভেঙে পড়বে।
দেশটির প্রথম সারির একাধিক মেডিকেল সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিদেশি মেডিকেল পর্যটকের সংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে কমেছে। বাংলাদেশি রোগীর পরিমাণ ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে। এটি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।
সম্প্রতি কেয়ার এজের রেটিং রিপোর্ট অনুসারে, ভারতের মোট চিকিৎসা পর্যটনে শতকরা প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ অবদান রাখে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল সংস্থা এ্যাপোলো হসপিটালস এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড জানাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক রোগীদের থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আদায়ে শতকরা ১৫ শতাংশ কমেছে। এর অন্যতম কারণ প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীর সংখ্যা কমে যাওয়া। কারণ বাংলাদেশি রোগীদের থেকে যে রাজস্ব আদায় হতো তা ২৭ শতাংশ কমে গেছে।
মধ্য কলকাতার প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় ১০০টি হোটেল এবং প্রায় ৩ হাজার দোকান রয়েছে। এগুলো পুরোপুরি নির্ভরশীল বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর। জানা গেছে, ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন থেকে কর্মী প্রত্যাহার এবং সাময়িক ভিসা প্রদান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। ফলে বাংলাদেশি পর্যটকের অভাবে তিন মাসের বেশি সময় ধরে খাঁ খাঁ করছে মারকুইস স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট, টটি লেন, কিড স্ট্রিট, রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডসহ নিউমার্কেটের বিস্তীর্ণ এলাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কলকাতা নিউমার্কেটের ব্যবসা-বাণিজ্য বাংলাদেশিদের ওপর নির্ভর করে। কলকাতার ইএম বাইপাসের ধারে একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসাও নির্ভর করে তাঁদের ওপর।
জানা গেছে, গত ১০ দিনে নিউমার্কেট এলাকায় অন্তত চার থেকে পাঁচটি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যয়বহুল এই অঞ্চলে ৮০ থেকে ১০০ বর্গফুটের একটি ঘরের মাসিক ভাড়া এক থেকে দেড় লাখ রুপি। পর্যটক না আসায় ভাড়ার টাকাই জোগাড় করা যাচ্ছে না।
কলকাতার মার্কুইস স্ট্রিট ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং এমারেল্ড হোটেলের মালিক মনোতোষ সরকার জানান, ভিসা বন্ধ হওয়ায় আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশি পর্যটকরা ভারতে আসতে পারছেন না। যে কারণে আমরা সমস্যায় পড়ে গেছি।
তিনি জানান, আগস্ট মাসের আগেও এই অঞ্চলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বাংলাদেশি আসা-যাওয়া করতেন। বর্তমানে তা পাঁচ শতাংশে নেমে এসেছে। এদিকে টানা তিন মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস এবং কলকাতা-খুলনা বন্ধন এক্সপ্রেস। বাস চলাচল করলেও মোট আসন সংখ্যার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না।
নিউমার্কেটের বিশিষ্ট প্রসাধনী দ্রব্যের দোকান রয়্যাল স্টোরের পঞ্চম প্রজন্মের মালিক অজয় সাউ বলেন, গোটা নিউমার্কেটের জন্যই ভয়াবহ। ভারতের মেডিকেল সেক্টরেও করুণ দশা। কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী শহরতলির বিভিন্ন হাসপাতালে বড় সংখ্যক বাংলাদেশি রোগীরা চিকিৎসা করাতে আসতেন। ভিসা জটিলতায় তারা আসতে পারছেন না। কলকাতা ও ভারতমুখী না হয়ে অন্য দেশে চিকিৎসা করতে যাচ্ছেন রোগীরা।
নেফ্র কেয়ার ইন্ডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিনিয়র নেফ্রলজিস্ট ডা. প্রতীম সেনগুপ্ত জানান, বর্তমানে রোগী সংকট সাময়িক। আগামী দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং চিকিৎসা শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে।
মরকুইস স্ট্রিটে কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সাইন্সেস (আর এন টেগোর) হাসপাতালের অধীন একটি আউটলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমডি জাফর জানান, আগস্ট মাস থেকেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছে। তার অভিমত, বর্তমানে ২০ শতাংশ বাংলাদেশি রোগী কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তবে তাদের বেশির ভাগই পুরনো ভিসায় অবস্থান করছেন।