চলার পথে যাওয়ার সময় একজন মায়ের কোলে একটি অসুস্থ বাচ্চাকে কিছু একটা খাওয়াতে দেখলাম। বাচ্চার মা খুব বিরক্তির সুরে বিড়বিড় করছিলো আর বাচ্চার বাবাকে অভিশাপ দিচ্ছিলো। এই বাচ্চা প্রতিবন্ধী হওয়াতে বাচ্চার মা নাকি অভিশপ্ত এই মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর বাবা জন্মের পরেই মা ও বাচ্চাকে রেখে চলে গেছেন। কিন্তু মা তো আর এই নিরীহ প্রতিবন্ধী বাচ্চাকে ফেলে রেখে যেতে পারেন না। মা তো মা ই।
মা এই ছোট্ট ছেলে শিশুর নাম রেখেছেন সিহাব। বিশ্বাস করুন ছোট্ট সিহাব ও তার মায়ের অসহায়ত্ব আর আর্তনাদের এই নিদারুণ নিষ্ঠুর পরিস্থিতি দেখে এবং বাচ্চার মায়ের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনে চোখে আর পানি ধরে রাখতে পারি নি।
আরেকটি মেয়েটির নাম তানহা। বয়স মাত্র ৬ বছর। একেবারে শিশুর মতো নিষ্পাপ চেহারা, তবে জন্ম থেকেই তাঁর শরীর অন্যদের মতো কাজ করে না। ডাক্তাররা বললেন, তানহার সেরিব্রাল পালসি হয়েছে। হাত, পা, এমনকি কথা বলার শক্তিও ঠিকমতো নেই। কিন্তু বাবা মায়ের চোখে অনেক স্বপ্ন—"আমাদের মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে। সে বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।"
তানহার বাবা-মা দিনমজুর। তবে তাঁরা মেয়ের চিকিৎসা করাতে চান। গ্রামের মানুষ বলেছিল, "এ তো বোঝা! এত টাকা খরচ করে কী হবে?" কিন্তু প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে এমন কিছু মহৎপ্রাণ মানুষ তাঁদের পাশে দাঁড়ায়। তানহার চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা করানো হচ্ছে তানহার। সীমাহীন খরচ। বিভিন্ন মানুষের মানবিক সহায়তায় চলে তানহার চিকিৎসা। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ একটি স্কুলে তাকে ভর্তি করানো হয়। আজ তানহা হুইলচেয়ারে বসে লিখতে শিখেছে, মুখে তারা মায়াবী নিষ্পাপ হাসি ফুটেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, "সেরিব্রাল পালসি এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যা শিশুদের চলাফেরা, সামগ্রিক কার্যক্রম সরাসরি মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলে।" বাংলাদেশে এর সংখ্যা কম নয়। অনেকেই মনে করেন, এরা কোনোদিন সমাজের কাজে আসতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই শিশুরা একটু সুযোগ পেলে নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে হয়ে উঠতে পারে সমাজের গর্ব।
রাফির সাফল্য
রাফি যখন ৫ বছর বয়সে প্রথম বিশেষ স্কুলে যায়, কেউ ভাবেনি সে একদিন স্বাবলম্বী হবে। কিন্তু স্কুলের সহায়তা, দানশীলদের বিশেষ অনুদান, বিভিন্ন সংস্থার আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা, এবং পরিবার থেকে ভালোবাসা পেয়ে আজ রাফি একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। তার ডিজাইনগুলো এখন অনলাইনে বিক্রি হয়।
আলমের সংগ্রাম
আলম সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত একজন তরুণ। হাঁটতে পারেন না, কথা বলতেও কষ্ট হয়। কিন্তু স্থানীয় এক সমাজকর্মীর সহায়তায় সে কম্পিউটারের কাজ শিখেছে। এখন সে একটি প্রতিষ্ঠানে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করছে। তার আয়ে তাদের মধ্যবিত্ত পুরো পরিবার চলছে।
সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শুধু শারীরিক চিকিৎসা নয়, প্রয়োজন সমাজের মানবিক সহায়তা। এসকল মানুষদের কে সহানুভূতির সাথে দেখতে হবে। পরম মমতায় তাদেরকে হাত বুলিয়ে দিতে হবে। তাহলে তারা একটি হৃদ্যতা মূলক প্রশস্ত ও উদার মানবিক পরিবেশ পাবে। তাদের জন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
চিকিৎসা ও থেরাপি: উন্নত ফিজিওথেরাপি ও চিকিৎসা পেলে তারা অনেকটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: সেরিব্রাল পালসি আক্রান্তদের জন্য আলাদা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
আর্থিক সহায়তা: থেরাপি, যাতায়াত, ও শিক্ষা খরচের জন্য নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
কর্মসংস্থানের সুযোগ: বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কাজ শেখানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
আমরা অনেক সময় এই মানুষগুলোকে অবহেলা করি। তাদের অসহায় ভাবি। কিন্তু একবার ভাবুন, আমাদের একটু সহায়তা, একটি হুইলচেয়ার, একটি বিশেষ থেরাপি মেশিন—এগুলো তাদের জীবনে কী পরিবর্তন আনতে পারে। সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত সহো সকল প্রতিবন্ধী মানুষরা কখনোই নিজেরা সাহায্য চাইতে পারে না। তাদের পরিবারের আর্তনাদ আমরা যদি না শুনি, তাহলে কে শুনবে? আমাদের উচিত ব্যক্তিগত ভাবে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য তহবিল গঠন করা, চিকিৎসার খরচ বহন করা এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থানের সূযোগ তৈরী করে দেওয়া।
একটি শিশুর জীবনে আলোর ঝলকানি আনতে হলে প্রয়োজন শুধু একটু মানবিক সহায়তা। সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত সহো সকল প্রতিবন্ধী মানুষেরা কোনোভাবেই সমাজের বোঝা নয়। তারা আমাদের ভালোবাসা, সুযোগ এবং সহায়তা পেলে নিজের মেধা দিয়ে সমাজের অন্যতম সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।
‘তানহার মতো, সিহাবের মতো আরও অনেক শিশু এই পৃথিবীতে বাঁচতে চায়, হাসতে চায়, স্বপ্ন দেখতে চায়। আপনার একটি ছোট সহায়তা হয়তো বদলে দিতে পারে একটি জীবন।’