চলমান জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৯) আয়োজনকারী আজারবাইজানের জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা নিয়ে সমালোচনা নতুন নয়। এর মাঝে জাতিসংঘের এ সম্মেলনে দেশটির বিশেষ মর্যাদা নিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির নির্বাহী ও লবিস্টদের অংশগ্রহণ নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ অতিথিরা ‘লাল গালিচা’ সুবিধা পাচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, হোস্ট কান্ট্রি ব্যাজধারীদের মধ্যে রয়েছেন সৌদি তেল কোম্পানি আরামকোর প্রধান আমিন নাসের ও কোম্পানিটির নয় কর্মকর্তা। ভিআইপি হিসেবে আরেক সুবিধাভোগী হচ্ছে সৌদি জ্বালানি কোম্পানি এসিডব্লিউএ, যার অধীনে কয়লা, গ্যাস ও নবায়নযোগ্য সম্পদ রয়েছে।
২৪ জন কর্মকর্তা নিয়ে সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন কোম্পানিটির সিইও মার্কো আর্চেলি। বিপির সিইও মারে অচিনক্লসও হোস্ট কান্ট্রি পাস পেয়েছিলেন, তার সঙ্গে রয়েছেন কোম্পানির সাত কর্মকর্তা। বিপি আজারবাইজানে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে এবং দেশটির জ্বালানি তেল ও গ্যাস কার্যক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এক্সনমবিলের প্রধান ড্যারেন উডস এবং তার তিনজন সহকর্মীও বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়েছেন। এ তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর জাতিসংঘের সম্মেলনে বৈশ্বিক জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানি ও পেট্রোস্টেটের প্রভাব নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ জানিয়েছেন।
আজারবাইজানের এবারের জমায়েতে উন্নয়নশীল দেশে জলবায়ু সংকট মোকাবেলা এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য তহবিল সংগ্রহের উপায় নিয়ে আলোচনা করছেন অংশগ্রহণকারীরা। এর মাঝে জ্বালানি কোম্পানির উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি উঠেছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তনের আহ্বান জানান। তার মতে, এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে জলবায়ু নিয়ে শক্তিশালী পরিকল্পনা নেই এমন দেশ বার্ষিক সম্মেলন আয়োজন থেকে বিরত থাকে ও জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির প্রভাব বন্ধ হয়।
আল গোর বলেন, ‘কপ’ কোথায় অনুষ্ঠিত হবে তা নির্ধারণে জাতিসংঘ মহাসচিবকে ভূমিকা রাখতে হবে। তিন বছর ধরে পেট্রোস্টেটগুলো এ সম্মেলন আয়োজন করছে। স্পষ্টতই এতে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।’
সম্মেলনে কারা আমন্ত্রিত হবেন সে বিষয়েও নির্দিষ্ট মানদ- পূরণ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আল গোর বলেন, ‘মানদ- হওয়া উচিত—তাদের দেশ কি সত্যিকার ও বিশ্বাসযোগ্য নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে? যদি না থাকে, তবে নয়। তারা কি জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদন কমানোর পরিকল্পনা করেছে?
তারা কি তাদের অস্বাভাবিক মুনাফার যথেষ্ট অংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করছে? তারা কি তাদের অ্যান্টি-ক্লাইমেট লবিং বন্ধ করবে? তারা কি তাদের গ্রিনওয়াশিং বন্ধ করবে?’
মার্কিন এ রাজনীতিবিদের মতে, যেসব কোম্পানি এ মানদ- পূর্ণ করতে ব্যর্থ হবে, তাদের জলবায়ু সম্মেলনের বাইরে রাখা উচিত। আল গোরের এ আহ্বান একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে। শুক্রবারের ওই চিঠিতে প্যারিস চুক্তির প্রভাবক হিসেবে কাজ করা ১৯৯২ সালের ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়। ইউএনএফসিসিসির নীতি অনুসরণ করে কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সাবেক প্রধান, সাবেক মহাসচিব ও জলবায়ুবিষয়ক সাবেক দূত। জটিল হলেও অনেকে ইউএনএফসিসিসি অনুসরণ সমর্থন করেছেন।
গবেষণা সংস্থা পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহাম্মদ আডোর মতে, অনেক ছোট উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি একমাত্র স্থান যেখানে তারা জলবায়ু সংকটের জন্য দায়ী বড় অর্থনীতিগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে।
তিনি বলেন, ‘কপ নিখুঁত না হলেও এটি গত দশকে বিশ্বের জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিতে অবদান রয়েছে। কোনো সংস্কার এমনভাবে হওয়া উচিত, যা প্রক্রিয়াকে দুর্বল না করে বরং শক্তিশালী করে। এই ফোরামটি একমাত্র স্থান যেখানে দুর্বল দেশগুলোকে টেবিলে বসার সুযোগ পাওয়া যায়। এটি একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, যার জন্য বৈশ্বিক সমাধান প্রয়োজন।’
প্যারিস চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ফরাসি কূটনীতিক লরেন্স টুবিয়ানা। তিনি এখন ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের সিইও। এক এক্স বার্তায় লরেন্স টুবিয়ানা লিখেছেন, ‘বহুপক্ষীয় আলোচলা হলো জলবায়ু সমস্যা সমাধানের ভিত্তি। প্যারিস চুক্তি সম্ভব হয়েছিল, কারণ প্রতিটি দেশ একেকটি কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল। সংস্কার প্রক্রিয়াটি শক্তিশালী করতে হবে, নয়তো এর সমঝোতা তৈরির ক্ষমতা ও বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
গত বছর দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ২৮-এ নিজেদের পরবর্তী বছরের সম্ভাব্য আয়োজক হিসেবে উপস্থাপন করেছিল আজারবাইজান। ওই সময় রাশিয়া কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশের আয়োজক হওয়ার প্রস্তাবে ভেটো দিলে প্রস্তাব বাকুর পক্ষেই যায়। ফলে ইউএইর পর আরেকটি জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদক দেশ আয়োজক হিসেবে মনোনীত হয়। আজারবাইজানের জ্বালানি তেল ও গ্যাস শিল্পের যাত্রা গত শতকের মাঝামাঝিতে।
দেশটির অর্থনীতি মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল, যা তার মোট রফতানির ৯০ শতাংশের বেশি। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ গত সপ্তাহে সম্মেলনের শুরুতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসকে ‘সৃষ্টিকর্তার উপহার’ বলে উল্লেখ করেন। এ সময় উৎপাদক দেশ নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে ‘ভুয়া খবর’ প্রকাশের সমালোচনা করেন তিনি। অভিযোগ সত্ত্বেও আয়োজক দেশটি সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহে ‘সৎ মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে ভালো কাজ করছে, এমনটি দাবি করেছেন আলোচনা থাকায় বিশেষজ্ঞরা।