জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর কাছে অনুদান হিসেবে পাঁচ লাখ কোটি ডলার দাবি করেছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জোট জি-সেভেনটি সেভেন। ২০৩০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক এই নতুন অর্থায়ন লক্ষ্য ঠিক করেছে তারা। তবে কপ-২৯ সম্মেলনে এই প্রশ্নে একমত হতে পারেনি উন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। ২০২৪ সালে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় অন্তত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে তাপমাত্রা। উষ্ণতম দশক পার করছে বিশ্ব। কথা ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত রাখতে হবে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের সবুজ তহবিলে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার দেবে কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো। তবে তাপমাত্রা না কমে বেড়েছে ০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের জলবায়ু সম্মেলনে নতুন করে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জোট জি-সেভেনটি সেভেন। তাদের দাবি, ২০৩০ সাল পর্যন্ত বছরে অনুদান হিসেবে দিতে হবে ১ লাখ কোটি ডলার।
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর টিকে থাকতে এ ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজন ট্রিলিয়ন ডলার। এ খাতে আমরা মানুষের পক্ষ থেকে বছরে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দের দাবি জানিয়েছি। ওয়ার্ল্ড চেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল এ বিষয়ে স্টাডি করে জানিয়েছে বছরে এ খাতে ৫.৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা সম্ভব। ২০০০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সবুজ তহবিলে ২০ হাজার কোটি ডলার এসেছে ঋণ হিসেবে। তবে জলবায়ু ক্ষতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত নয় এই অর্থ। অনুদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সিইপিআরডির প্রধান নির্বাহী ড. মোহাম্মদ শামছুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর কাছে অনুদান হিসেবে পাঁচ লাখ কোটি ডলার দাবি করেছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জোট জি-সেভেনটি সেভেন। তবে ‘কপ-২৯’ সম্মেলনে এই প্রশ্নে একমত হতে পারেনি উন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। কারণ উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে বিনিয়োগে লাভের নিশ্চয়তা চায়। যেমন বাংলাদেশকে যদি কোনো উন্নত দেশ জলবায়ু পরবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১০০ ডলার ঋণ দেয় নির্দিষ্ট সময় পর এই সুদসহ এই অর্থ বাংলাদেশ ফেরত দিতে পারবে কিনা সেই নিশ্চয়তা। এই নিশ্চয়তা না দিতে পারলে ঋণও অনিশ্চিত। আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলন শেষে দেশের প্রতিনিধিরা বলছেন, জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। তবে সে অর্থ আদায়ে অনড় অবস্থানেই থাকছে বাংলাদেশ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত সমস্যা : সামোয়া থেকে তিনটি বিমান পাল্টে তারপর বাসে চড়ে ২৪ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আজারবাইজানের বাকুতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৯) যাওয়ার কথা ছিল পরিবেশকর্মী জ্যাকব নেজলারের। কিন্তু এত জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন উড়িয়ে তিনি সেখানে যাননি। পরিবর্তে তিনি মেক্সিকোর ওক্সাকাতে চলে যান। সেখানে তিনি ‘জলবায়ু ও জীবনের জন্য বৈশ্বিক জমায়েত’-এ অংশ নেন। যদিও আয়োজকরা এ জমায়েতকে ‘অ্যান্টি-কপ’ বা বিকল্প জলবায়ু সম্মেলন হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। এই জমায়েতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের চেয়ে আলাদা সুরে কথা বলা হয়। সেখানে কপ সম্মেলনের মতো বিলাসবহুল হোটেলের ব্যবহার হয় না, ব্যক্তিগত বিমানে ডরমিটরিস ভরে থাকে না কিংবা জলবায়ুতে প্রভাব ফেলে এমন টয়লেটও ব্যবহার করা হয় না। এই বিকল্প জলবায়ু সম্মেলনের মাধ্যমে পরিবেশ কর্মীরা জাতিসংঘের চেয়েও কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লড়াইয়ে। কার্যত পরিবেশকর্মীদের এই বিক্ষোভ-প্রতিবাদেই টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী ও প্রাণ প্রকৃতি।
জ্যাকব নেজলার তাই ট্রুথআউটকে বলছিলেন, অ্যান্টি-কপ সম্মেলন বাস্তবে সেসব লোকদের একত্রিত করতে পারে যাদের জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না। গেল সপ্তাহ থেকে বাকুতে এবারের বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৯ শুরু হয়। বিগত ৩০ বছর ধরেই এ সম্মেলন হচ্ছে। কিন্তু গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধে এই সম্মেলনের কার্যকর কোনো ভূমিকা আজ অবধি চোখে পড়েনি। তাই তো চলতি বছরের কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। বিখ্যাত সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গও শুরু থেকেই এবারের সম্মেলনের বিরোধিতায় সোচ্চার ছিলেন। সম্মেলনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে তিনি এই সম্মেলনটিকে ‘পরিবেশ বান্ধবের ভান করে দেওয়া ধোঁকা’ উল্লেখ করেন। আয়োজক দেশ আজারবাইজানেও বিক্ষোভ করেছেন পরিবেশবাদীরা। পরিবেশ দূষণের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবিতে ইতালির রোমেও অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্লাইমেট প্যারেড। আর জি টোয়েন্টি সম্মেলন শুরুর প্রাক্কালে জোটের নেতাদের উদাসীনতার প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে ভিন্নধর্মী এক প্রদর্শনী করেছে ব্রাজিলের আদিবাসী সংগঠন।
অ্যান্টি-কপ বা বিকল্প জলবায়ু সম্মেলনগুলো সাধারণত কপ সম্মেলনের সাথে একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। তবে এটি কখনো কখনো আলাদা স্থানেও হয়েছে। প্রথম বিকল্প জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয় ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে কপ-১৫ সম্মেলন ঘিরে। সেবার জলবায়ু আন্দোলনকারীরা মূল সম্মেলনের কাঠামোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। সেখানে প্রতিবাদ, অযথা আলোচনা এবং করপোরেট স্বার্থের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হওয়ার দাবি তুলেছিল তারা।
এরপর কপ-১৬ (২০১০, কানকুন) এবং কপ-১৭ (২০১১, দোহা)-তে প্রতিবাদ এবং বিকল্প জলবায়ু সম্মেলনের পরিসর বাড়তে থাকে। পরে পরিবেশবাদী এবং জলবায়ু আন্দোলনকারীরা দলে দলে এই বিকল্প সম্মেলনে অংশ নিতে শুরু করেন। জলবায়ু সম্মেলন ঘিরে কেন এই বিক্ষোভ তা বুঝতে হলে প্রথমে এই সম্মেলনের মুখ্য বিষয়াবলি এবং এতে বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান জানা জরুরি।
কপ-২৯ সম্মেলনের মূল বিষয় বেশ কয়েকটি। যেমন- বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সেগুলোর সমাধান খুঁজে বের করা। বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধ করতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা তৈরি করা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা ইত্যাদি।
এসব বিষয় জলবায়ুর জন্য অতীব জরুরি। তবে বিক্ষোভকারীরা মনে করেন, কপ সম্মেলনগুলোতে একের পর এক আলোচনা হলেও বাস্তব পরিবর্তন আসতে অনেক সময় লাগছে। অনেক দেশের বিরুদ্ধে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় এবং তারা যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়ই না। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ক্ষতিপূরণের দাবিদার। কিন্তু উন্নত দেশগুলো এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চায় না। আবার পরিবেশবাদীরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ না করা এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসে বিনিয়োগ না করা নিয়েও ক্ষুব্ধ।
এই বিক্ষুব্ধদের দাবি হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে আরও কঠোরতা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং বিশ্বনেতাদের জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আরও দৃঢ় ও সুস্পষ্ট অবস্থান।
সত্যি বলতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে আর আস্থা নেই পরিবেশ কর্মীদের। এই সম্মেলন বৈশ্বিক নেতাদের ওপর জলবায়ু রক্ষার্থে কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়ে আসছে। তাই পরিবেশবাদীরা একরকম বিকল্প জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের আওয়াজ তুলছে। কারণ প্রচলিত সম্মেলনগুলোতে প্রায়ই বড় বড় দেশ ও করপোরেট সংস্থাগুলোর প্রভাব বেশি থাকে। কিন্তু বিকল্প সম্মেলনে স্থানীয় সম্প্রদায়, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। প্রচলিত সম্মেলনে নতুন ধারণা, প্রযুক্তি এবং সমাধানের ওপর জোর দেওয়া হলেও আলোচনা প্রায়ই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে আটকে পড়ে। তবে বিকল্প সম্মেলনগুলোয় সমাধানের দিকে বেশি নজর পরিবেশবাদীদের। তাছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও সমাধান নিয়ে আলোচনাও করতে চায় পরিবেশবাদীরা।
বিকল্প সম্মেলনের মাধ্যমে তারা চায় উন্নত দেশগুলোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমানো এবং নতুন শক্তি উৎসের সন্ধান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা পরিবর্তন এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সমাধান খোঁজা। কার্যত এমন বিকল্প জলবায়ু সম্মেলন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে যা আরও বাস্তবসম্মত ও কার্যকর সমাধানের দিকে এগিয়ে নেবে পৃথিবীকে।