সংস্কার নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডাগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। সেই সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে সরকারের সামনে থাকা সুপ্ত বিপদগুলো। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার যদি লক্ষ্য পূরণে সফল না হয়, তবে এর বিকল্পগুলো সুখকর হবে না। অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ১০০ দিন নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে।
ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ সংঘাত ও যুদ্ধ প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী আগাম সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়ে থাকে। ক্রাইসিস গ্রুপ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে নিবিড় দৃষ্টি রাখছে। গতকাল সংস্থাটি ‘বাংলাদেশে নতুন যুগ? সংস্কারের প্রথম ১০০ দিন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ক্রাইসিস গ্রুপের মায়ানমার ও বাংলাদেশবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক থমাস কিয়ান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে মুহাম্মদ ইউনূস শপথ নেওয়ার ১০০ দিন পর দেশটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার শাসনব্যবস্থার উন্নতি করার এবং আরেকটি স্বৈরাচারী সরকারের উত্থান ঠেকানোর এমন সুযোগ ‘এক প্রজন্মে একবারই’ আসে। কিন্তু কাজের পরিমাণ বিশাল। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে ছাত্রনেতা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, ইসলামী দলগুলো, সামরিক বাহিনী এবং সুধীসমাজসহ মূল রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে।’
থমাস কিয়ান বলেন, ‘এরই মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি, সাংবিধানিক পরিবর্তন এবং নির্বাচনী সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ইউনূসকে ক্ষমতায় আনা ভঙ্গুর জোটে ফাটল দেখা দিয়েছে।
এই সরকারের প্রতি যে ব্যাপক জনসমর্থন, তা ধরে রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারকেও তার দৈনন্দিন শাসনব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।’
জ্যেষ্ঠ পরামর্শক থমাস কিয়ান বলেন, ‘ইউনূস ও তাঁর সরকার যদি হোঁচট খায়, তাহলে দেশটি ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধে সামান্য কিছু নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাসহ নির্বাচিত সরকারে ফিরে যেতে পারে। এমনকি সামরিক শাসনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কিন্তু তারা যদি সংস্কার পরিচালনায় সফল হন, তাহলে বাংলাদেশিরা আগামী কয়েক দশকের জন্য উপকৃত হতে পারে।’
গবেষণার প্রধান ফলাফল
ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার তিন মাস পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার অ্যাজেন্ডা আরো স্পষ্ট হচ্ছে।
একই সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে সামনে এগোনোর পথে থাকা সুপ্ত বিপদও। নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার আরো এক বছর এবং সম্ভবত এর চেয়েও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পর শাসনব্যবস্থার উন্নতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করার এক প্রজন্মে একবার আসে এমন সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ, যা আরেকটি স্বৈরাচারী সরকারের উত্থানের পথ বন্ধ করতে পারে। যদি এই অন্তর্বর্তী সরকার হোঁচট খায়, তবে দেশটি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে অথবা এমনকি সামরিক শাসনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
যা করণীয়
ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কারের জন্য জনসমর্থন ধরে রাখতে দ্রুত ফলাফল দৃশ্যমান করা অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ সরকারের অনেক বেশি সময় ক্ষমতায় থাকাটা এড়ানো উচিত এবং নতুন পদক্ষেপের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। দেশের বাইরের পক্ষগুলোর উচিত সহায়তার হাত বাড়ানো। বিশেষ করে, ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণের মাঝে দেশটির ভাবমূর্তি মেরামতে কাজ করা।
জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনার গণ-অভ্যুত্থানে পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়ে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দ্রুতই রাজনৈতিক, শাসনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের সাহসী এজেন্ডার একটি চিত্র তুলে ধরে। বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি তুলে ধরে অনেক বাংলাদেশিই হাসিনার পতনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ (১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি ইঙ্গিত করে) হিসেবে অভিহিত করছেন।
ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের প্রতি ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। কিন্তু জনপ্রত্যাশার ভালো-খারাপ দুই ধরনের পরিণতিই রয়েছে। যদি সংস্কার আনতে অন্তর্বর্তী সরকার হোঁচট খায়, সম্ভবত এর পরিণতি দাঁড়াতে পারে সামান্য অগ্রগতিসহ একটি আগাম নির্বাচন; সবচেয়ে খারাপ দৃশ্যপটে, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে।
ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার মূল সংস্কারগুলো ঘিরে ঐকমত্য গড়ে তুলছে এবং দেশকে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করছে। সরকারকে তার সামাজিক সমর্থনের ভিতকে শক্তিশালী রাখতে কিছু দ্রুত অর্জনের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। জাতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন যুগের সূচনায় সাহায্য করতে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর উচিত ইউনূসের প্রশাসনকে সমর্থন দেওয়া এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা।
ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘হাসিনার বিদায়ে যে উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল তা টিকে আছে, কিন্তু সামনের পথের রূঢ় বাস্তবতা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এরই মধ্যে বাজে অবস্থায় থাকা অর্থনীতি ধীরে এগোচ্ছে। এক মাসের বেশি সময়ের বিক্ষোভ এবং ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে অনিশ্চয়তায় অর্থনীতি আরো ধাক্কা খেয়েছে।’
ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, ড. ইউনূসের সরকার প্রধানত বিক্ষোভবিরোধী দমন-পীড়নে ব্যাপকভাবে জড়িত একটি পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিদ্যমান আইনে জোড়াতালি দেওয়া আইনি ভিত্তির কারণে জনসমর্থন ধরে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনও হবে ড. ইউনূসের সরকারের অনেক বড় অর্জন। এই সরকার বাংলাদেশে এ যাবৎকালের সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক হলেও এর অনেক সদস্যের সরকারে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। প্রধান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সমর্থন ধরে রাখা এরই মধ্যে চ্যালেঞ্জিং প্রমাণিত হচ্ছে। কেউ কেউ নির্বাচনের সুবিধার জন্য অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি ইউনূসের মিত্ররাও সাংবিধানিক সংস্কার এবং শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত নৃশংসতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে আসছেন।
নির্বাচনের দাবি জোরালো হবে
ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ এখন বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। এর পরও ড. ইউনূসকে আওয়ামী লীগপন্থী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বাধার মুখেও পড়তে হতে পারে।
ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, পূরণ করা তো দূরের কথা, আকাশচুম্বী জনপ্রত্যাশা সামলানোই বড় চ্যালেঞ্জিং। অভিজ্ঞতা বলে, অন্তর্বর্তী সরকার যত বেশি ক্ষমতায় থাকতে চাইবে, আগাম নির্বাচনের দাবি তত জোরদার হবে এবং সরকারের বৈধতা নিয়ে আরো বেশি সন্দেহ দেখা দেবে। ইউনূস সরকার সমাজের দুর্বল গোষ্ঠীগুলোকে আঘাত করতে পারে—এমন অর্থনৈতিক সংস্কার এবং হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনে জবাবদিহি কতটুকু করবে—এমন বিষয়সহ অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে। অনেক বাংলাদেশি আওয়ামী লীগের নিপীড়নের প্রতিশোধ নিতে চায়। ড. ইউনূস সঠিকভাবেই এমন প্ররোচনাকে প্রশ্রয় দিতে আগ্রহী নন।
চ্যালেঞ্জ প্রচুর, সুযোগও অভূতপূর্ব
ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও চ্যালেঞ্জ প্রচুর, তবু এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের সামনে অভূতপূর্ব এক সুযোগ নিয়ে এসেছে। ১৯৯০ সাল থেকে দুটি দল—হাসিনার আওয়ামী লীগ আর তাঁর চরম প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার বিএনপি রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। তারাই পালাক্রমে সরকার গঠন করেছে।
ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি—উভয়েই রাষ্ট্রীয় অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করেছে। তারা দলীয় বাহিনী লালন, নির্বাচনী কানুন বিকৃত এবং ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে সুবিধাভোগী চক্র তৈরি করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা এসব কৌশলকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যান এবং বাংলাদেশিদের অনেক দূরে ঠেলে দেন। ফলে তিনি ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর ওপর আরো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও ভারসাম্য স্থাপনে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘এক প্রজন্মে একবার মিলে’ এমন সুযোগ করে নিয়েছেন।
ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিক সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য হলো, বিগত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদ এবং অনুগত অযোগ্যদের নিয়ে গঠিত প্রশাসনব্যবস্থা যাতে ফিরে আসতে না পারে তা নিশ্চিত করা। এমনকি ইউনূসের টিম এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কতটা সফল হতে পারবে তা স্পষ্ট নয়। তবে বিকল্পগুলো সুখকর নয় বলেই মনে হচ্ছে।