শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগের দিন তার চাচার বাড়ি খুলনার আলোচিত জমজমাট সেই শেখ বাড়ি এখন পরিত্যক্ত ও ভূতুড়ে বাড়ি।
নগরীর শেরেবাংলা রোডে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন ও শেখ সালাহউদ্দীন জুয়েলের শেখ বাড়ি’র অবস্থান। শেখ হেলাল উদ্দিন বাগেরহাট-১ ও শেখ সালাহ উদ্দীন জুয়েল খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। ভিআইপি শেখ বাড়িটিতে ছিলো কয়েকটি স্থরের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায়। ভেতরেও ছিল পুলিশ প্রশাসনের রাত্রীকালীন পাহারার ব্যবস্থা।
শেখ পরিবারের সদস্যরা যখন আসতেন তখন মানুষ থৈ থৈ করতো ভবনটিতে। ভবনের সামনে থাকতো তাদের পাঁচ ভাইয়ের অনুসারী নেতাকর্মীদের বিভিন্ন নামিদামী ব্যান্ডের গাড়ির সারি। দীর্ঘ জ্যাম লেগে থাকতো বাড়ির সামনের সড়কটিতে। কিন্তু সেই বাড়িটিতে এখন সুনসান নীরবতা। অগ্নিকান্ডে পুড়ে ক্ষতবিক্ষত ভবনটি দেখলে এখন মনে হচ্ছে পোড়া কোনো ভূতুড়ে বাড়ি সুদৃশ্য বাড়ির ভবন। ভবনের ভেতরের পুরো অংশ পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ভবনটির দরজা-জানালাও নেই। ৪ ও ৫ আগস্ট বিক্ষুদ্ধ জনতার কয়েক দফা হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পর বাড়ির ইটের অবকাঠামো ছাড়া আর কিছু নেই। বাসিন্দারা বাড়িটি ছাড়েন হামলার আগের দিন। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন বাড়িটি দেখতে আসছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী বা দীর্ঘদিন যারা এই বাড়ি থেকে সুবিধা নিয়েছেন, তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এই বাড়ি ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। তারাই আওয়ামী লীগে বড় বড় পদ-পদবি পান। তাদের কাছে দলের ত্যাগী নেতারা ছিলেন কোণঠাসা। এ নিয়ে ছিল চাপা অসন্তোষ, কিন্তু শেখ বাড়ির ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না। গত ১৬ বছরে খুলনাসহ আশপাশের কয়েকটি জেলার ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করে শেখ বাড়ি’র সদস্যরা হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
খুলনা মহানগরীর শেরেবাংলা রোডে শেখ বাড়ি’র মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই ও সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন এবং তাঁর চার ভাই। হেলাল উদ্দিন ঢাকায় থাকেন, তবে খুলনায় এলে থাকতেন এই বাড়িতে। তাঁর ভাই সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল, বিসিবির পরিচালক ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বাবু কখনও ঢাকায় কখনও খুলনার বাড়িতে থাকতেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে খুলনা উত্তাল হয়ে উঠলে ২ অথবা ৩ আগস্ট চার ভাই শেখ বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে যান বলে জানা যায়। তারা দেশত্যাগ করেছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। ক্ষমতাধর পাঁচ ভাইয়ের বর্তমান অবস্থানের সঠিক তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই বাড়িতে হামলা হয়েছে কয়েক দফা। হামলাকারীরা ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা এসি, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ, আসবাব, লাইট, বাড়ির গ্রিল এমনকি গেটও খুলে নিয়ে যায়। শনিবার দুপুরে শেখ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ইটের অবকাঠামো ছাড়া দোতলা বাড়িতে কিছুই নেই। আগুন দেওয়ার কারণে দেয়ালের রং কালো হয়ে গেছে। বাড়িতে একজন কর্মচারীও নেই।
শেখ বাড়ি দেখতে আসা খালিশপুরের পাটকল শ্রমিক আব্দুল হক বলেন, এই বাড়ি খুলনায় বেশ আলোচিত। শুনেছি, সাধারণ মানুষ সহজে ঢুকতে পারত না। এখান থেকে নাকি খুলনার রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো। বড়বাজারে একটা কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম শেখ বাড়ির কী অবস্থা তা দেখে আসি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারী রফিক বলেন,জুয়েল সাহেব ও সোহেল সাহেব বাড়িতে থাকলে বিভিন্ন লোকজন আসত। বাড়িটি মধ্যরাত পর্যন্ত সরগরম থাকত। বাড়ির সামনে দামি গাড়ির সারি দেখা যেত। হাসিনা সরকার পতনের পর এখন বাড়ির মালিক শেখ হেলালসহ অন্য ভাইদের বর্তমান অবস্থান পলাতক থাকায় খুলনায় ক্ষমতার কেন্দ্র শেখ বাড়িতে কোনো লোকও আসে না।
আশপাশের দোকানিরা জানান, বিক্ষুব্ধ জনতা ৪ আগস্ট প্রথম দফায় হামলার পর কিছু পুলিশ ও ফারাজীপাড়া রোডের যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ আলী লোকজন নিয়ে ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন। পরের দিন আবারও হামলা হলে কেউ এগিয়ে আসেননি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং দীর্ঘদিন যারা এই বাড়ি থেকে সুবিধা নিয়েছেন, তারাও আসেননি। বাড়িটি এখন পুরোপুরি পরিত্যক্ত। প্রকৃতপক্ষে বাড়িটির কোনো নাম নেই, তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরিচিতি পায় শেখ বাড়ি হিসেবে।
স্থানীয় লোকজন বলেন, গত ১৬ বছর, বিশেষ করে ছয় বছর ধরে বাড়িটি খুলনায় ‘ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ, চাকরিতে নিয়োগ ও বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়াঙ্গনসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো এই বাড়ি থেকে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন এমনকি পেশাজীবী সংগঠনগুলো চলত এই বাড়ির নির্দেশনায়। দলের কমিটি গঠন করে দিতেন তারা। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা খুলনায় বদলি হয়ে এসে হাজিরা দিতেন খুলনার বহুল আলোচিত শেখ বাড়িতে।
উল্লেখ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই বাড়িটি পরিচিতি পায় শেখ বাড়ি হিসেবে। এই বাড়ি থেকেই খুলনা সহ দেশের সব শীর্ষ সন্ত্রাসী ,কিলার ও গডফাদাররা নিয়ন্ত্রিত হতো। খুলনার আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সব কার্যক্রম চলতো এই বাড়ী থেকেই। সদ্য পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন ও তাঁর চার ভাইয়ের গনভবন ছিলো এই শেখ বাড়ি । এক কথায় এই ‘শেখ বাড়ির আঙুলের ইশারায় চলতো দক্ষিণাঞ্চল। তবে খুলনাবাসী শেখ বাড়িকে অভিশপ্ত বাড়ি হিসেবেই চিনতো। কারণ এখানে অনেক নিরীহ মানুষের কলাকাটা হত। জমি দখল থেকে মাদক নিয়ন্ত্রণ সব কিছু পরিচালিত হত এই অভিশপ্ত শেখ বাড়ী থেকেই । কেউ শেখ বাড়ির অবাধ্য হলেই পুলিশ বা পালিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে তাকে ধরে এনে টর্চার করা হতো।