মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাজার মূল্যের চেয়ে ৯১৬.৪৪ কোটি টাকা বেশি খরচ করে মেঘনা গ্রুপ এবং ভারতের আদিত্য বিড়লা গ্রুপের কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ৩.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা ক্রয়ে ভয়াবহ দুর্নীতির খবর জানা গেছে।
গত বছর ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি মাতারবাড়ি পাওয়ার প্ল্যান্টে ৩ বছরব্যাপী ৯.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে (দুই খাম বিশিষ্ট)। দরপত্রটি কয়লা ক্রয় সম্পর্কিত হওয়ায় মূল দরপত্রে কয়লা আমদানির অভিজ্ঞতার শর্ত উল্লেখ ছিল।
কিন্তু একাত্তর টিভির মালিক মেঘনা গ্রুপ ও ভারতের আদিত্য বিড়লা গ্রুপের কনসোর্টিয়াকে বেআইনি সুবিধা দেয়ার উদ্দেশ্যে হাসিনা সরকারের দুর্নীতিবাজ অফিসাররা দরপত্রে পরপর চারটি সংশোধনীর মাধ্যমে ‘কয়লা আমদানির অভিজ্ঞতার’ শর্তটি পরিবর্তন/পরিবর্ধন করে ‘কয়লা অথবা লোহা, সার, কেমিক্যাল, সিমেন্ট, খাদ্য শস্য আমদানির অভিজ্ঞতা’কে যোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামসহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠান ওই দরপত্রে অংশগ্রহণ করে ৩টি প্রতিষ্ঠানকেই টেকনিক্যালি নন-রেসপনসিভ হিসেবে বাদ দিয়ে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারতের আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়ামকে গত ১ মে টেকনিক্যালি রেসপনসিভ ঘোষণা করা হয়। গত ৮ মে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তাবটি খুলে দেখা যায় যে, তারা প্রতি টন কয়লার সরবরাহ মূল্য প্রতি মেট্রিক টন ১০৮.৮৭ ডরার প্রস্তাব করেছে।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তাবটি মূল্যায়ন করে জানায় , ওই দর উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি বিধায় ৯.৬ মিলিয়ন টন কয়লা সরবরাহের একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়’ এবং প্রস্তাবিত দর গ্রহণযোগ্য নয় বলে সিদ্ধান্ত প্রদান করে।
পরবর্তীতে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামের অনুকূলে কার্যাদেশ প্রদান ইস্যু না করায় তারা গত ১ জুলাই এবং ৮ জুলাই পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি ৫৭(৫) এবং ৫৭(৭) অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের করে কিন্তু কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বা মন্ত্রণালয় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের অভিযোগ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এরপর আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়াম পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি ৫৭(১০) অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিভিউ প্যানেলে কোনো আপিল বা হাইকোর্টে কোন রিট মামলাও দায়ের করেনি।
আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তাব খারিজ হওয়ার পর তারা কোনো আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহণ না করায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামের দরপত্র বা প্রস্তাব বিবেচনা করার আর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত ১৭ অক্টোবর কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সম্পূর্ণই বেআইনিভাবে আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়াম বরাবরে ৩.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা প্রতি টন ১০৫.৮৭ মার্কিন ডলার সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ প্রদান ইস্যু করে বাজার মূল্যের চেয়ে ৯১৬.৪৪ কোটি টাকা বেশি খরচ করে কয়লা ক্রয় করছে।
উল্লেখ্য, সরবরাহের জন্য প্রস্তাবিত কয়লা অবশ্যই ইন্দোনেশিয়ান কয়লা সূচক (আইসিআই)-৩ গ্রেডের হওয়ার শর্ত রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ান কয়লা সূচক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪-এ আইসিআই-৩ গ্রেড কয়লার বাজার মূল্য ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৭৩.২৫ মার্কিন ডলার এবং TEC এর হিসাব অনুযায়ী প্রতি মেট্রিক টন কয়লার পরিবহণ খরচ ১০.৮০ মার্কিন ডলার। অতএব ১৭ বা ১৮ অক্টোবর ২০২৪ কয়লার মূল্য ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৭৩.২৫+১০.৮০ =৮৪.০৫ মার্কিন ডলার। কিন্তু কোল পাওয়ার কোম্পানি পূর্বের ন্যায় দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে, প্রতি মেট্রিক টন ১০৫.৮৭ মার্কিন ডলার হারে আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়ামের অনুকূলে কার্যাদেশ প্রদান জারি করেছে যা প্রতি মেট্রিক টন কয়লার বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে ২১.৮২ মার্কিন ডলার বেশি ধার্য করা হয়েছে।
সুতারাং কোল পাওয়ার কোম্পানি কয়লার বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে ৯শ ১৬ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার বেশি দামে কয়লা ক্রয় করে কোল পাওয়ার কোম্পানি রাষ্ট্রের প্রায় ৯শ ১৬ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতি করছে যা সুস্পষ্টরূপে দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড।
উল্লেখ্য, কয়লা ক্রয়ের ওই দরপত্র বিষয়ে কোল পাওয়ার কোম্পানি বোর্ড এবং মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম এবং দুর্নীতি ও চক্রান্তমূলক কার্যক্রম বিষয়ে ইতিপূর্বে দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আরও উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা আমদানি অতীব জরুরি এই বিবেচনায় মন্ত্রণালয় এবং কোল পাওয়ার কোম্পানির কর্মকর্তারা তড়িঘড়ি করে অবৈধভাবে আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়াম বরাবরে কার্যাদেশ প্রদান করেছে। যদিও জরুরি প্রয়োজনে সরাসরি কয়লা ক্রয়ের মাধ্যমে সাময়িক চাহিদা পূরণ করার বিষয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে।
এমতাবস্থায় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের লক্ষ্যে এবং দেশকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হতে রক্ষার লক্ষ্যে কয়লা ক্রয়ের জন্য প্রদত্ত কার্যাদেশ বাতিল করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।