দেশের এক তৃতীয়াংশ পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলা পাবনা। এ জেলার সুজানগর, বেড়া, সাঁথিয়া সহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় রেকর্ড পরিমাণ পেঁয়াজের আবাদ হয়। তবে চলতি মৌসুমে বৈরী আবহাওয়া এবং সার, বিষ ও বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় মুড়িকাটা পেঁয়াজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এ জেলার কৃষক।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে ভিন্নকথা, চলতি মৌসুমে কিছুটা খরচ বাড়লেও রোপণে দেরি ও স্বল্প পচনে পেঁয়াজ আবাদে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। চলতি মৌসুমেও কৃষকরা পেঁয়াজের ভালো ফলন ও ন্যায্য দাম পাবে বলে তারা মনে করছেন।
কৃষি বিভাগ জানান, চলতি মৌসুমে পাবনায় পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৮০১ হেক্টর। এরমধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৫৮০ হেক্টর। বর্তমান আবাদ হয়েছে ২ হাজার ১২৩ হেক্টর। এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আবাদ কম হয়েছে ৬ হাজার ৪৫৭ হেক্টর।
কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি মৌসুমে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ২২ হাজার ৫৯৬ টন। তারা জানান, এ পেঁয়াজ বাজারে আসতে সর্বোচ্চ ৮০ দিন সময় লাগে। তবে এবছর বৃষ্টির ফলে মাটির জোর বৃদ্ধি পাওয়ায় আরো কম সময় লাগবে বলে জানান তারা। তাই ডিসেম্বরের শেষের দিকে এ পেঁয়াজ বাজারে আসবে বলে আশাবাদি কৃষি বিভাগ।
সাধারণত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপণ করেন পাবনার কৃষক। মৌসুমি পেঁয়াজের আগে এই পেঁয়াজ বাজারে আসায় ও সরবরাহ থাকায় অনেকটাই বাজার নিয়ন্তণ রাখে এ পেঁয়াজ। তবে এবছর বৃষ্টির ফলে জমিতে পানি জমে থাকায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ দেরিতে পেঁয়াজ রোপণ করছেন এ জেলার কৃষক। ফলে এবার মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরেছেন তারা।
পেঁয়াজ চাষিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবছর মুড়িকাটা পেঁয়াজ বীজের দাম বেড়েছে। ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা মণের বীজের দাম বেড়ে হয়েছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। তাছাড়া হাজার টাকা বিএডিসি ড্যাপ সারের দাম বেড়ে হয়েছে ১২শ থেকে সাড়ে ১২শ টাকা। এমনকি ১৫শ টাকার বাংলা ড্যাপের দাম বেড়ে হয়েছে ১৭শ থেকে ১৮শ টাকা। এছাড়াও কৃষিপণ্য, শ্রমিক মজুরি থেকে শুরু করে সবকিছুতেই গতবছরের তুলনায় খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ।
কৃষকরা জানান, ইতিমধ্যে আবারও বৃষ্টিপাত হওয়ায় মাটির নিচ থেকে নিচু জমির বীজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এবছর অনাবৃষ্টিতে কিছু জমির অঙ্কুর হওয়া চারাও পঁচে যাচ্ছে। তাই আবারও জমিতে বীজ রোপণে খরচ, সময়মতো বাজারে পেঁয়াজ উঠতে না পাড়া ও ফলন কমে যাওয়া সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
কথা হয় সুজানগর উপজেলার কৃষক মকবুল মিয়ার সাথে। তিনি জানান, চলতি মৌসুমে তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করছেন তিনি। এবছর এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করতে খরচ হয়েছে তার ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এছাড়াও ফসল ঘরে তুলতে মণ প্রতি প্রায় আড়াই হাজার টাকার মত খরচ হবে বলে তিনি মনে করছেন। তিনি জানান, এছাড়াও সার বিষ ও বীজের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় এবছর আবাদ নিয়ে বিপাকে পড়ছেন তিনি। কৃষক মকবুল মিয়া জানান, এবছর চড়া সুদে লোন নিয়ে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ করছেন তিনি। তাই এবছর মণ প্রতি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পারলে ব্যাপক লোকসানে পরবেন বলে জানান তিনি।
কথা হয় একই এলাকার কৃষক আরিফের সাথে। তিনি জানান, এবছর জমি থেকে পানি নামতে একটু দেরি হওয়ায় সময়মতো বীজ রোপণ করতে পারেননি তারা। এখন পর্যন্ত কিছু জমিতে মাটি চাষ উপযুক্ত না হওয়ায় পেঁয়াজ রোপণ করতে পারেননি তারা। তিনি জানান, এখনোও এসকল জমিতে বীজ রোপন করতে তিন থেকে চারদিন সময় লাগবে। পেঁয়াজ রোপণ পিছিয়ে পড়ায় এবছর পেঁয়াজ আবাদে মার খাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তিনি জানান, দেরিতে পেঁয়াজ রোপন করলে গাছে ফুল বেশি হয় তবে তুলনামূলক ফলন কমে যায়। তিনি জানান, প্রতিবছর বিঘা প্রতি প্রায় ৬০ করে ফলন পেলেও এবছর বিঘা প্রতি প্রায় পাঁচ থেকে দশ মণ ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
গোপালপুর গ্রামের আ. মজিদ বলেন, এবছর ১০ বিঘা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ করছেন তিনি। তবে বৃষ্টির কারণে ৫ বিঘা জমির পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে তার। তিনি জানান, এমনিতেই এবছর বেশি দামে বীজ কিনতে হয়েছে। তারপরে আবার বৈরি আবহাওয়ায় ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। তাই ফের পেঁয়াজ রোপন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি।
সদ্য অঙ্কুর হওয়া পেঁয়াজ পরিচর্যা করছিলেন ইউনুছ মৃধা ও জহিরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন কৃষক। তারা জানান, এ মৌসুমে দেরিতে পেঁয়াজ রোপন করায় ফলন অনেকটা কম হবে। তবে কৃষক পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য পেলে হয়তো ঘুরে দাড়ানো সম্ভব হবে।
তারা অভিযোগ করে বলেন, বাজারে পিঁয়াজ কিনতে গেলে ১ কেজি পেঁয়াজ দেড় থেকে দুইশত টাকায় কিনতে হয়। অথচ বিক্রি করতে গেলে দাম নেই। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা এভাবেই দিনের পর দিন তাদের ঠকাচ্ছে বলে জানান তারা।
তারা আরও জানান, অধিকাংশ কৃষকই চড়া সুদে লোন নিয়ে চাষাবাদ করে থাকে। তাই কৃষক বাঁচাতে নতুন সরকারের প্রতি ন্যায্যমূল্য দাম নির্ধারণ করার অনুরোধ জানান তারা।
এ বিষয়ে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) রোকনুজ্জামান ভোরের পাতাকে বলেন, বৃষ্টির ফলে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পেঁয়াজ রোপণ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে এতে করে এ জেলার কৃষকেরা পিছিয়ে নেই, কারণ নভেম্বর অবধি মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদের সময় থাকে। এছাড়া বৃষ্টির কারণে নিচু জমির খুবই স্বল্প পেঁয়াজ পঁচতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ফলনে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া ভালো থাকলে ও মুড়িকাটা পেঁয়াজের ভালো ফলন ও দাম পেলে কৃষকরা লাভবান হবে বলে জানান তিনি।