গিরগিটি নামটা একটু অদ্ভুত হলেও বাস্তবে এটি বিস্ময়কর প্রাণী। চোখের পলকে নিজের রং বদলে পরিবেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে। মূলত শিকারি থেকে বাঁচতে নিজের শরীরের এমন বিবর্তন ঘটায়। বিপদের আঁচ পেলেই মুহূর্তের মধ্যেই সবুজ, হলুদ, নীল রঙে নিজেকে পাল্টে ফেলে গিরগিটি। এই গিরগিটিও যেন হার মানবে অগ্রণী ব্যাংকের জিএম শামীম রেজার কাছে।
বিগত ১৬ বছরে অগ্রণী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় আওয়ামীপন্থী শামীম রেজা এখন বিএনপি। অগ্রণী ব্যাংক মূল ভবনের চতুর্থ তলায় জিএমের কক্ষে চেয়ারে বসে এখন হাসিনাকে তুলোধুনো করছেন নিয়মিত আর তারেক রহমানের জয়গান গেয়ে নিজেকে বিএনপি প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভোল পাল্টিয়ে রাতারাতি বিএনপি হয়ে গেছেন এই শামীম রেজা। আওয়ামী শাসন আমলে ব্যাংকিং খাতে সুবিধাভোগীদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন এই শামীম। ব্যাংকপাড়ায় অর্থ লুটপাটের পাশাপাশি বদমেজাজি ও নারীলোভী হিসেবে দুর্নাম রয়েছে তার।
গত ১৬ বছরে একের পর এক প্রমোশন হাতিয়ে প্রিন্সিপাল অফিসার থেকে হয়েছেন জিএম। অগ্রণী ব্যাংকে আওয়ামী দলীয় পরিচয়ে রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন এই ব্যাংকার দুর্বৃত্ত। হাসিনার পতনের পর কোণঠাসা শামীম রাতারাতি ভোল পাল্টিয়ে ফেলেছেন। নিজেকে এখন বিএনপির পরিচয় দিয়ে আবারও সাম্রাজ্য গড়ার অপচেষ্টা করছেন।
ঘুষ, দুর্নীতি, অধীনস্থ নারী সহকর্মীর সাথে যৌন কেলেঙ্কারি- শামীম রেজার নানা অপকর্মের ঝুলিতে সব অভিযোগই রয়েছে। তার বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগের পরও কিভাবে যেন সবই ম্যানেজ করে ফেলেন তিনি। এখন বিএনপি দলীয় পরিচয়ে ডিএমডি হবার দৌড় শুরু করেছেন।
আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি বনে যাওয়া শামীম রেজাকে প্রশ্ন করলে তিনি চটজলদি উত্তর দেন- ডিএমডি হবার পরীক্ষায় তিনি অংশগ্রহণ করবেন না।
বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের পক্ষে দলবাজি আর গলাবাজির নানা প্রমাণপত্র আর ভিডিও তুলে ধরলে চটজলদি কেটে পড়েন। বিক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। যা খুশি লিখতে পারেন।’
প্রমোশন বাগিয়ে নিতে একসময় বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে কটাক্ষ ও স্বাধীনতার শত্রু আখ্যায়িত করে বক্তব্য দিলেও বর্তমানে ডিএমডি পদে আসীন হতে তিনি বিএনপির পরিচয় ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকে বঙ্গবন্ধু কর্ণার স্থাপন করে নিজেকে বড় আওয়ামী লীগার পরিচয় দিয়ে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছ থেকে পুরস্কারও গ্রহণ করেছেন তিনি।
অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক সিইও এবং এমডি মোরশেদুল কবিরের সিনেট নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন শামীম রেজা । এসময়ে অগ্রণী ব্যাংকের সব শাখা থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদা তুলে আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া বঙ্গমাতা পরিষদ নামে একটা কমিটি করে প্রমোশন, পোস্টিং নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অবৈধ পথে কানাডায় অর্থপাচার আর সেই টাকায় তার দুই সন্তানকে সেখানকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন বলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। সম্প্রতি তার কানাডা সফরের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করেছেন বলেও কানাঘুষা চলছে অগ্রণী ব্যাংকে। একজন জিএম কত টাকা অবৈধ পথে উপার্জন করলে তার দুই ছেলে-মেয়ে কানাডায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে- এমন প্রশ্ন তুলছেন শামীম রেজার সহকর্মীরা।
এছাড়াও পাচারকৃত এসব অর্থ দিয়ে তিনি কানাডায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। শামীম নিজের কালো টাকা সাদা করতে জামালপুরের সরিষাবাড়ি হরখালী গ্রামে তাকওয়া মসজিদ কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছেন। তিনি নিজ গ্রামে মসজিদ মাদ্রাসায় ব্যয় করেন এসব অবৈধ অর্থ। যার নেপথ্যে রয়েছে কালো টাকা সাদা করা।
শামীম রেজার বিরুদ্ধে ঢাকা সার্কেল-১ এর জিএম থাকাকালীন দুই জুনিয়র কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে নিপীড়ন, যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে তাকে তাৎক্ষণিক বদলী করা হয়। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যাবহার করে এসব অভিযোগ ধামাচাপা দেন তিনি।
যৌন হয়রানি বিষয়ে ভুক্তভোগী এক নারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি শেষ হয়ে গেছে। তিনি অনুরোধ করে বলেন, এ নিয়ে লেখালেখি হলে আমার ক্ষতি হবে, অসুবিধায় পড়তে হবে।’
এদিকে ময়মনসিংহ সার্কেলের জিএম থাকাকালীন অনেক ভুয়া ঋণ অনুমোদন করেছেন যা এখন খেলাপী হয়ে পড়েছে। অগ্রণী ব্যাংকে পল্টিবাজ শামীম রেজার দৌরাত্ম্যের শেষ দেখতে চান ভুক্তভোগীরা। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম সার্কেলেরও দায়িত্বে। এই সার্কেলের বিভিন্ন শাখা থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন বলে অভিযোগ আছে। আবার রিকভারি বিভাগের জিএম তিনি। এই সুযোগে বিভিন্ন বড় বড় পার্টির কাছ থেকে ঋণ আদায় না করে তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা আদায় করে নেন।
এসব অপকর্মের প্রতিটি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি হন্তদন্ত হয়ে বলেন, ‘এসব বিষয়ে তার সম্পৃক্ততা নেই। তার কোনো মন্তব্যও নেই।
শামীম রেজার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় তার স্ত্রীর কাছেও। তিনি জানান, অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তাদের সন্তান তার মামায় বাসায় থেকে চাকরি করে পড়াশোনা খরচ চালায়।