বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.) ছিলেন মানুষের জন্য দয়া, ক্ষমাশীলতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, দানশীলতা, মহানুভবতা, পরোপকার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীলতা, সাহসিকতা, বীরত্ব ও ন্যায়পরায়নতাসহ সব মহৎ গুণের শীর্ষস্থানীয় আদর্শ। আর তাঁর পর এইসব গুণ সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখা গেছে তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের মধ্যে। বিশেষ করে, আমিরুল মু’মিনিন হজরত আলী (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)’র আদর্শের পূর্ণাঙ্গ প্রতিভু। আকাশের উদারতা ও স্বর্গীয় মহত্ত্বগুলো ছিল তাঁর ভূষণ।
বিখ্যাত এই সাহাবি হজরত আলীর (রা.) শৈশব কেটেছিল রাসুল (সা.)-এর বাড়িতে। তাঁর অভিভাবকত্ব ও তত্ত্ববধায়নে। আলী (রা.)-এর বাবা আবু তালিবের সংসার ছিল বেশ বড়। একবার মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। এ সময় আবু তালেবের পরিবার চালাতে বেশ বেগ পেতে হলো।
আবু তালিব ছিলেন মুহাম্মদ সা.-এর চাচা। তিনি দাদা, মা-কে হারানোর পর চাচার কাছেই বড় হয়েছিলেন। দুর্ভিক্ষের দিনে চাচার কষ্টের বিষয়টি মুহাম্মদ সা.-কে বেশ পীড়া দিলো। তিনি চাচার কষ্ট কমাতে তার সঙ্গে পরামর্শ করে চাচাতো আলীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। তাঁর সবকিছুর দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করলেন।
আলী (আ.)’র জীবনের অনেক বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনা বা মু’জিজা রয়েছে। যেমন, জন্মের সময় পবিত্র কাবা ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে আবার তা মিলিয়ে যাওয়া যাতে তাঁর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ তাঁকে জন্ম দিতে পারেন, রাসূলের (সা.) ওফাতের পর কুবা মসজিদে রাসূল (সা.)-কে জীবিত অবস্থায় দেখানো, সূর্যকে পেছনে ঘুরিয়ে দেয়া যাতে সঙ্গীরা সময়মত নামাজ আদায় করতে পারেন ইত্যাদি ।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন: মক্কা বিজয়ের পর ফেরার পথে এক রাতে মহানবী (সা.) আলী (আ.)-কে বলেন যে, সূর্য যখন উদিত হবে তখন তুমি সূর্যের সঙ্গে কথা বলবে। আমি ফজলকে বললাম দেখবো আলী কিভাবে সূর্যের সঙ্গে কথা বলে। সূর্য ওঠার পর আলী (আ.) সূর্যকে লক্ষ্য করে বলেন: সালাম তোমায় হে সূর্য, তুমি আল্লাহর সৎ দাস ও আল্লাহর নির্দেশ পালনে অবিচল।
সূর্য জবাবে বলল: ওয়া আলাইকাসসালাম হে আল্লাহর রাসূলের ভাই!
আসমা বিনতে উমাইস বর্ণনা করেন হযরত ফাতিমা জাহরা (সা. আ.) বলেছেন: কোনো এক রাতে আলী (আ.) ঘরে প্রবেশ করলে আমি ভীত হয়ে পড়ি। আসমা বলেন: হে বিশ্বের নারীকুলের নেত্রী! কিভাবে ভয় পেয়েছিলেন আপনি! তিনি বলেন: আমি শুনলাম যে জমিন বা মাটি আলীর সঙ্গে কথা বলছে এবং আলীও জমিনের সঙ্গে কথা বলছেন!
ছোটবেলা থেকেই রাসূল সা.-এর কাছে থাকার ফলে প্রথম কয়েকজন ইসলামগ্রহণকারীর কাতারে নিজের নাম লেখানোর সৌভাগ্য অর্জন করেন আলী রা.। হজরত খাদিজা রা., ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের পরই ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি রাসূল সা.-এর সঙ্গে নামাজ আদায় করেন।
ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের মতে, মহানবী সা. নবুয়ত লাভের পরদিন আলী রা. নবী সা. ও খাদিজা রা.-কে নামাজ পড়তে দেখে জিজ্ঞেস করেন, এটা কী?
জবাবে তিনি বলেন, এটা আল্লাহর দ্বীন। এ দ্বীন নিয়েই নবীগণ পৃথিবীতে আগমন করেন। আমি তোমাকে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। তুমি তাঁরই ইবাদত করো এবং লাত-উযযাকে অস্বীকার করো।
আলী রা. বললেন, এতো সম্পূর্ণ নতুন কথা। এর আগে এমন কথা কখনো শুনিনি। আমি আমার বাবা আবু তালিবকে জিজ্ঞেস না করে এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারবো না।
তখন মুহাম্মদ সা. মাত্রই নবুয়ত লাভ করেছিলেন, আল্লাহ তায়ালাও প্রকাশ্যে মানুষকে ইসলামের প্রতি আহ্বানের নির্দেশ দেননি। তাই আলী রা. আবু তালিবকে বিষয়টি জানালে জটিলতা তৈরি হয় কি না— ভেবে রাসূল সা. তাঁকে বললেন, আলী তুমি ইসলাম গ্রহণ না করলেও আপাতত কারো কাছে এ কথা ফাঁস করবে না।
মুহাম্মদ সা.-এর কাছে এই কথা শোনার পর আলী রা. কাউকে কিছু বললেন না। চুপচাপ থাকলেন। তবে এরপর আর একদিনও কাটলো না। পরদিন সকালে তিনি রাসুল সা.-এর কাছে এসে বললেন, আপনি কীসের আহ্বান করছেন?
রাসুল সা. বলেন, সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক নেই। লাত-উযযাকে অস্বীকার করো, মূর্তিপূজার প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করো’।
রাসূল সা.-এর কাছে এ কথা শোনার পর আলী রা. ইসলাম গ্রহণ করলেন। দীর্ঘকাল পর্যন্ত (কিছু বর্ণনামতে এক বছর) বাবা আবু তালিবের কাছে নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখলেন তিনি। (সীরাতুল মুস্তফা সা. ১/১৩৬)
৪০ হিজরির ১৯ রমজান হযরত আলী (আ) কুফার গ্র্যান্ড মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ার সময় এক খারিজি সন্ত্রাসীরা তরবারির হামলায় আহত হয়েছিলেন এবং তিনি একুশে রমজান শাহাদাত বরণ করেন।