মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ৫৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে এক ঝটিকা সফরে আজ শুক্রবার ঢাকায় এসেছেন। ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই প্রথম ঢাকা সফর।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) দুপুরে তিনি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এ সময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। তার এ সফরে দুদেশের বাণিজ্য ও শ্রমবাজারসহ নানা ইস্যুতে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
যেহেতু বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বৃহৎ বাজার মালয়েশিয়া, ফলে বিষয়টি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যে সংকট চলছে সে আলোচনা গুরুত্বের কেন্দ্রে থাকতে পারে বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশ্লেষকরা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক মোটর শোভাযাত্রা সহকারে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে নেওয়া হবে। সেখানে তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠক করবেন। পরবর্তীকালে দুই নেতা দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে আলোচনা করবেন। সেখানে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শ্রম অভিবাসন, শিক্ষা, প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিস্তৃত বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মালয়েশিয়া বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজারগুলোর একটি। মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগের বিষয়ে ১৯৯২ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তির পর বেশ কয়েক বছর ভালোই চলছিল এ শ্রমবাজার। কিন্তু কয়েক বছর চলার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৯৬ সালে আবার সে দেশের শ্রমবাজার চালু হয়। এরপর আবার ২০০০ সালে নিজেদের চাহিদা বিবেচনায় সে দেশের সরকার বিশেষ অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেয়।
এদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আবারও সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)। এই খাতকে সিন্ডিকেটের প্রভাবমুক্ত রাখতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে সংগঠনটি।
মালয়েশিয়া শ্রমবাজার চক্রে সাবেক ৪ এমপি
মালয়েশিয়া শ্রমবাজার নিয়ে গঠিত চক্রে ঢুকে বাণিজ্য করা চার সাবেক সংসদ সদস্যের (এমপি) বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চক্রটি দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে।
দুদক সূত্র জানায়, সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি অভিযোগ অনুসন্ধান করবে। অভিযোগের বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে দুদক।
এই চক্রের চার সাবেক সংসদ সদস্য হলেন নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ ও আ হ ম মুস্তাফা কামাল। চক্রে থাকা দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের নামে, অন্যটি মেয়ে নাফিসা কামালের নামে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তাঁরা সবাই আত্মগোপনে আছেন। এর মধ্যে আ হ ম মুস্তাফা কামাল সিঙ্গাপুরে বলে জানা গেছে।
সারসংক্ষেপে বলা হয়, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড নামে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন। এরপর সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে পাঠায় স্নিগ্ধা। মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট বা চক্রে যোগ দেওয়ার পর দেড় বছরে প্রায় ৮ হাজার কর্মী গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির নামে।
সারসংক্ষেপের তথ্য বলছে, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ২০১৫ সালে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল নামে রিক্রুটিং এজেন্সি করেন। মালয়েশিয়ায় এককভাবে শ্রমিক পাঠানোর শীর্ষে রয়েছে ফাইভ এম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আড়াই হাজারের মতো কর্মী পাঠালেও মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে ৮ হাজার ৫৯২ কর্মী।
ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর দিক থেকে পঞ্চম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। মালয়েশিয়া শ্রমবাজার চালুর আগে তাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। বিদেশে পাঠিয়েছিল মাত্র ২৩৮ কর্মী। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে তারা শীর্ষ তালিকায় চলে যায়। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছেন ৭ হাজার ৮৪৯ কর্মী। চক্র গঠনের সময় বেনজীর ছিলেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছেন মোট ৯ হাজার ৮৬১ জন। চক্র গঠনের সময় তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
দুদক বলছে, তিন সংসদ সদস্য ও একজন সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যের এজেন্সির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং এ খাতের নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠায়। তবে বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশে এমন চক্র-ব্যবস্থা নেই। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। চক্রে থাকা এজেন্সিগুলো বসে বসে প্রতি কর্মীর বিপরীতে অন্তত দেড় লাখ টাকা ‘চক্র ফি’ পাচ্ছে।
অন্যান্য এজেন্সির মধ্যে অন্যতম হলো ঐশী ইন্টারন্যাশনাল, নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেড, পিআর ওভারসিজ, সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল, ইম্পেরিয়াল ওভারসিজ, বিএম ট্রাভেলস লিমিটেড এবং অনন্য অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সি।
দুদকের সারসংক্ষেপে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে চার লাখের মতো কর্মী পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। সরকার নির্ধারিত ফিয়ের চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চক্র ফি নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অনিয়ম অনুসন্ধান করে প্রতিবেদনের নির্দেশ আদালতের
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
‘চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও মালয়েশিয়া যেতে পারলেন না ১৭ হাজার কর্মী’ শিরোনামে গত জুন মাসে গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স ইউনাইটেড এক্সপোর্ট লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী এস এম রফিক গত ১৫ জুলাই রিটটি করেন।
আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. নাজিমুদ্দীন ও মো. আবুল কাশেম সেলিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আইনুন নাহার সিদ্দিকা।
আদেশের বিষয়টি জানিয়ে আইনজীবী মো. নাজিমুদ্দীন বলেন, হাইকোর্ট রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করে ৯০ দিনের মধ্যে দুদক ও বিএফআইইউকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন।
তিনি আরও বলেন, মালয়েশিয়া যেতে কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধে সরকার নির্ধারিত ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা প্রদান নিশ্চিত করতে একটি পরিপূর্ণ নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সব প্রক্রিয়া শেষে ১৭ হাজারের বেশি কর্মী যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির অবহেলা ও অনিয়মের কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানসচিব, পররাষ্ট্রসচিব, বাণিজ্যসচিব ও দুদক চেয়ারম্যানসহ বিবাদীদের ওই সময় চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল বলে জানান রিট আবেদনকারীর এই আইনজীবী।
টাকা ‘পাচারে’ আমিনুল ও রুহুল আমিন
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে চক্র গড়ে বিপুল টাকা পাচার করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ‘চক্র ফি’ হিসেবে কর্মীপ্রতি এক লাখ টাকা করে পাচার হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ভিসা ‘বাণিজ্যের’ নামে পাচার হয়েছে আরও ৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে পাচারের পরিমাণ দাঁড়াবে অন্তত ৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো সব রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত ছিল না। দেড় হাজারের বেশি এজেন্সির মধ্য থেকে ১০০ এজেন্সির একটি চক্র বা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। চক্রের সদস্যরা মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকার জায়গায় গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভেরিটে ইনকরপোরেটেডসহ পাঁচটি সংস্থার এক জরিপে (মে, ২০২৩)।
চক্রে থাকা দুটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন কীভাবে তাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে তা মালয়েশিয়ায় পাচার করা হতো। তারা বলেছেন, চক্রটির হোতা আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর, যিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক। বাংলাদেশে তার প্রতিনিধি মোহাম্মদ রুহুল আমিন ওরফে স্বপন।
চক্র গড়ে শ্রমিক পাঠানো, ঘুষ লেনদেন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারের দরজা বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত মে মাসে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে। মালয়েশিয়া বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজারগুলোর একটি।
রিক্রুটিং এজেন্সি হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার চক্রে না থাকলেও কর্মী পাঠিয়েছে অন্য এজেন্সির মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘যে এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠিয়েছি, তারা একজন কর্মীর শুধু বিএমইটি ছাড়পত্র করে দেওয়ার নামে ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা করে চক্র ফি নিয়েছে। এ ছাড়পত্র নিতে মূলত খরচ হয় ৬ হাজার টাকা। উড়োজাহাজের টিকিটসহ কর্মীর বাকি সব খরচ আলাদাভাবে করতে হয়েছে। এতে অভিবাসন খরচ বেড়েছে।’
যেভাবে পাচার
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে মাইগ্রাম নামের একটি সফটওয়্যারে কর্মীদের নাম নিবন্ধন করতে হয়, যার আনুষ্ঠানিক নাম ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডব্লিউসিএমএস)। এটির মালিকানা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূরের কোম্পানি বেস্টিনেটের হাতে। রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা বলছেন, প্রতি কর্মীর জন্য নিবন্ধন ফি ১০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (প্রায় ২ হাজার ৭০০ টাকা)। এর বদলে নেওয়া হয় প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার টাকা, যার মধ্যে স্থানীয় আদায়কারী প্রতিষ্ঠান ৭ হাজার টাকা রেখে বাকি ১ লাখ টাকা মালয়েশিয়ায় বেস্টিনেটকে পাঠিয়ে দেয়। লেনদেন হয় অবৈধভাবে।
মাইগ্রাম সফটওয়্যারে সেই সব প্রতিষ্ঠানেরই নাম থাকে, যারা চক্রের সদস্য। ই-ওয়ালেটের (অনলাইন লেনদেনের হিসাব) মাধ্যমে কর্মীপ্রতি ১০০ রিঙ্গিত ফি পরিশোধ করতে হয় চক্রের সদস্যদের। দুটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক প্রথম আলোকে বলেছেন, কর্মীপ্রতি ১ লাখ ৭ হাজার টাকা জমা দেওয়ার পর বেস্টিনেট ই-ওয়ালেট থেকে ১০০ রিঙ্গিত করে ফি জমা দেওয়ার সুযোগ দেয়, নইলে দেওয়া হয় না। সফটওয়্যারের নিয়ন্ত্রণ থাকে তাদের হাতে।
মালয়েশিয়া চক্রের দুই সদস্যের ভাষ্য, আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর বাড়তি টাকা নেন মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ দেওয়ার কথা বলে। বাংলাদেশে তার প্রতিনিধি রুহুল আমিন ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি এজেন্সির মালিক। এই প্রতিষ্ঠানের ঢাকার মাদানী অ্যাভিনিউয়ের কার্যালয়ে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসতে হতো। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা প্রতিদিন নগদ কোটি কোটি টাকা বুঝে নিতেন।
অভিযোগের বিষয়ে একটি গণমাধ্যম বক্তব্য জানতে চাইলে মালয়েশিয়ার আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ক্যাথারসিসের মালিক রুহুল আমিনকেও মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।
তিনি গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ ছাড়েন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে গত ২০ জুন বলেন, ‘টাকা নেওয়া ও পাচারের অভিযোগ মিথ্যা। আমি কি অত পাওয়ারফুল কেউ, আমাকে কেন সবাই টাকা দেবে? আমিন সাহেবও একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরা কীভাবে এটা (শ্রমবাজার) নিয়ন্ত্রণ করবে?’ তিনি বলেন, ‘সব অনুমোদন দিয়েছে দুই দেশের সরকার। সব এজেন্সি মালয়েশিয়ায় আবেদন করেছে। এরপর জোর লবিং হয়েছে। যে এজেন্সির মালয়েশিয়ায় যোগাযোগ ভালো, তারা অনুমোদন পেয়েছে।’
সাধারণ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা বলছেন, বাংলাদেশ ছাড়া অন্য যেকোনো দেশে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি সব এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত। বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়ী মালয়েশিয়ায় অবৈধ লেনদেন করে চক্র গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ সরকার এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বেস্টিনেটের অনিয়মের বিষয়ে ২০২৩ সালে অভিযোগ জমা পড়েছিল বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। রিক্রুটিং এজেন্সি ও নিয়োগকর্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতে ওই বছর ৯ মে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে একটি চিঠি পাঠায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
এতে বলা হয়, বেস্টিনেট থেকে ই-ওয়ালেট টপআপ (টাকা ভরা) বরাদ্দ না করায় বেশ কিছু এজেন্সি মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছে। মালয়েশিয়ার একাধিক নিয়োগকারী কোম্পানিও বিষয়টি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। চিঠির অনুলিপি তারা বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
বায়রার পক্ষ থেকেও একই ধরনের অভিযোগে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ওই চিঠির ভিত্তিতে গত বছরের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ হাইকমিশনে একটি চিঠি পাঠায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, এফডব্লিউসিএমএসের মাধ্যমে নির্বাচিত অধিকাংশ রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মী সংগ্রহ ও পাঠানোর উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা ও সক্ষমতা নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিক্রুটিং এজেন্ট নির্বাচনের কারণে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি কর্তৃক উচ্চহারে অভিবাসন ব্যয় গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া কর্মীদের ই-ভিসার জন্য ১২টি অনুমোদিত ভিসা সেন্টার থাকার পরও শুধু এফডব্লিউসিএমএসের ঢাকা অফিস মালয়েশিয়া এমপ্লয়মেন্ট ফ্যাসিলিয়েশন সেন্টার (এমইএফসি) এককভাবে ই-ভিসা ইস্যু করে থাকে। একাধিক সেন্টার থেকে ভিসা ইস্যুর ব্যবস্থা করতে বলা হয় চিঠিতে।
বেস্টিনেটের সঙ্গে রুহুল আমিনের সম্পর্ক
অনুসন্ধানে মালয়েশিয়া চক্রের দুই হোতা বেস্টিনেটের আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর ও ক্যাথারসিসের মালিক মোহাম্মদ রুহুল আমিনের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের ২৪ মার্চ মালয়েশিয়ার বেস্টিনেট এ দেশে নিবন্ধন নেয় এবং বেস্টিনেট বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি খোলে। কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মালয়েশিয়ার আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ রুহুল আমিন।
বেস্টিনেট বাংলাদেশের ১২ হাজার শেয়ারের ১০ হাজার ছিল আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূরের নামে। দুই হাজার ছিল রুহুল আমিনের নামে। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ আমিন ইসলামের পুরো শেয়ার রুহুলের নামে হস্তান্তর করা হয়। ওই সময় পরিচালক হিসেবে যুক্ত হন রুহুলের ভাই সাইফুল ইসলাম। ২০২২ সালে কোম্পানিটি নাম বদল করে হয়ে যায় ক্যাথারসিস সলিউশনস লিমিটেড।
তবে রুহুল আমিন বলেন, মালয়েশিয়ার বেস্টিনেটের সঙ্গে বাংলাদেশের বেস্টিনেটের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি আলাদা কোম্পানি। বাংলাদেশে কোনো ব্যবসা না পাওয়ায় আমিনুল ইসলাম এটির অংশীদারত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
এদিকে মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচারের অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত ২৮ মে একটি চিঠি দিয়েছিলেন চক্রের সদস্য রিক্রুটিং এজেন্সি ইউনাইটেড এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম রফিক। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় টাকা পাচারের মূল হোতা রুহুল আমিন ওরফে স্বপন ও তার মালয়েশিয়ার অংশীদার আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর।
এস এম রফিক বলেন, চক্রে থাকা সব এজেন্সিকে প্রতি কর্মীর জন্য ১ লাখ ৭ হাজার টাকা করে ক্যাথারসিস কার্যালয়ে দিয়ে আসতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার মালয়েশিয়া চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গত ৫ আগস্ট তাদের পতনের পর অন্তর্বতী সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন বায়রার একাধিক সদস্য। ২২ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো বায়রার সদস্য মোস্তফা মাহমুদের চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, ২০১৭ সালেও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর চক্র গড়ে তুলেছিল আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর ও রুহুল আমিন। তখন ও এবার দুই দফায় ১৭ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা লুট করেছে চক্রটি।
বাংলাদেশ থেকে দেড় বছরের কিছু বেশি সময়ে চক্রে থাকা ১০০ এজেন্সির নামে ৪ লাখ ৯২ হাজার ৪১৬ জন কর্মীর ছাড়পত্র নেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, এসব নিয়োগপত্রের অন্তত অর্ধেক কেনা হয়েছে টাকার বিনিময়ে। তাতে খরচ হয়েছে কর্মী প্রতি গড়ে ৬ হাজার রিঙ্গিত বা দেড় লাখ টাকা। এর মাধ্যমে পাচার হয়েছে ৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এটি ভিসা–বাণিজ্য হিসেবে পরিচিত।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, চক্র ফি ও ভিসা–বাণিজ্যের নামে মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, যা মালয়েশিয়া থেকে আসা প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশের সমপরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মালয়েশিয়া থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ১১২ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা)।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিবেশী দেশ থেকে কর্মী যায় নিয়োগকর্তার খরচে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা। সরকার ধারাবাহিকভাবে এটা চলতে দিয়েছে। এটা খুবই ন্যক্কারজনক, কলঙ্কজনক, অমানবিক।
তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় একটা চক্র আছে, যারা বাংলাদেশি চক্রের প্রতিনিধি। প্রবাসী কর্মী ও রাষ্ট্রকে জিম্মি করে অবৈধ ব্যবসা ও টাকা পাচার করছে এ চক্র। যতদিন দায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া না হবে, ততদিন এটা চলতেই থাকবে।
অনিয়ম দূরীকরণে মন্ত্রণালয়কে বায়রার আবেদন
এদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বরাবর মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীদের জরুরি ভিত্তিতে মালয়েশিয়া পাঠানো প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী কর্মীদের পক্ষে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি (বায়রা) একটি আবেদন করে।
আবেদনে তারা উল্লেখ করে, মালয়েশিয়ান সরকার ঘোষিত নির্ধারিত সময় ৩১ মের মধ্যে কর্মী প্রেরণের নির্দেশ করা হয়। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং টিকেট সিন্ডিকেটের জন্য টিকিট সংকটের কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রেরণ করা সম্ভব হয়নি। প্রায় ১৯ হাজার কর্মীদের মধ্যে কিছু কর্মী মালয়েশিয় যাবে না মর্মে জানায় বিধায় তাদের অর্থ ফেরত দেয়া হয়। যারা এখনো যেতে ইচ্ছুক তারা বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাই যেসব কর্মীরা এখনো মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক তারা যেন বৈধ পথে মালয়েশিয়া গিয়ে স্ব স্ব কোম্পানিতে কাজ করতে পারে এ বিষয়ে মালয়েশিয়ান সরকারের সাথে আলোচনা/বৈঠক করার জন্য আবেদন করে।
এসব অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং টিকেট সিন্ডিকেটের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া এবং মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীরা যেন পরবর্তীতে কলিং VDR এবং ই-ভিসা এক্সটেনশন করে পুনরায় বৈধ পথে মালয়েশিয়া গিয়ে স্ব স্ব কোম্পানীতে কাজ করার সুযোগ পায় বলে আবেদন করে বায়রা।
পরিশেষে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাক্ষাতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ বিস্তৃত ইস্যুগুলো আলোচনা করে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমবাজারের সংকট, অবৈধ চক্র ও সিন্ডিকেট ভাঙবে বলে অভিবাসী বিশেষজ্ঞদের আশা।