এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি। সামগ্রিক উন্নয়নের পাশাপাশি সচল হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ জনজীবন ও জনপদ। মানুষ এখন আর আগের মতো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মধ্যে জীবনের প্রাপ্তি খোঁজে না। এখন খাওয়া পরার পাশাপাশি একটি উত্তম বাসস্থানের স্বপ্ন দেখে। সারা দেশের ন্যায় মাগুরার শালিখা উপজেলার গ্রামীণ জনজীবনে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। কয়েক বছর আগেও মানুষ মাথা গোঁজার জন্য দিন শেষে একটি মাটির দেওয়ালের ঘরে বসবাস করতো যার উপরে ছিল ছন বা খড়ের ছাউনি। বড় ঝড় হলেই উড়ে যেত ঘরের ছাউনি অতিবৃষ্টিতে ভেংগে পড়তো মাটির দেওয়াল। ঘটতো ছোট বড় নানা দুর্ঘটনা। কিন্ত এখন মাটির ঘর তেমন একটা চোখে পড়েনা যা দু-একটি দেখা যায় তা ব্যবহার করা হয় লাকড়ি বা ছাগল-গরু রাখার কাজে। এমনি একটি ঘরের দেখা গেছে উপজেলার ছান্দড়া গ্রামের এলেমপাড়ার শাহিদার বাড়িতে। মাটি দিয়ে তৈরি ঘরটি ব্যবহার করা হচ্ছে ছাগল রাখার কাজে। শাহিদা খাতুন বলেন, প্রায় ৫ বছর আগে ঘরটি তৈরী করা হয়েছিল বসবাস জন্য কিন্তু বর্তমানে ঘরটি ছাগল ও খড়ি রাখার কাজে ব্যবহার করছি। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে মাগুরার শালিখা উপজেলার মাটির তৈরি ঘরগুলো। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগুলোতে গত কয়েক বছর আগেও নজরে পড়ত মাটির ঘর। প্রচণ্ড গরম ও শীতে বসবাসের উপযোগী ছিল এই মাটির ঘর। তবে সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়নে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্ত হতে বসেছে মাটি দিয়ে তৈরি ঘরগুলো।
মানুষ এখন ভালো পোশাক পরিচ্ছদের পাশাপাশি উন্নত জীবনের জন্য বসবাস করছেন ইট-সিমেন্টের তৈরী পাকা বাড়িতে। সরেজমিন শালিখা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আধুনিকতার স্পর্শে এখন মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। গ্রামীণ অর্থনীতির গতি সচল হওয়ায় মাটির ঘরের পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে পাকা ঘর। কয়েক বছর পর পর মাটির ঘর সংস্কারের ঝক্কি-ঝামেলা ও ব্যয়বহুল দিক পর্যবেক্ষণ করে মাটির ঘরের পরিবর্তে দালানকোঠা বানাতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন এখনকার মানুষ। অধিকাংশ বাড়ি তৈরী করা ইট-সিমেন্ট বা উন্নত টাইলস দিয়ে। আড়পাড়া ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ধলা কাজী বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেখেছি প্রতিটা বাড়িতে মাটি-কাদা দিয়ে উঁচু উঁচু করে বসবাসের জন্য মাটির ঘর তৈরি করা হতো। গরমকালে মাটির ঘর অনেক ঠান্ডা থাকতো ঠিক যেন এসির মতো। তবে মাটির ঘরের ভালো দিকের পাশাপাশি অনেক মন্দ দিকগুলোও ছিল। তালখড়ি ইউনিয়নের সাবলাট গ্রামের শামসুর বলেন, গ্রাম অঞ্চলে নিচে মাটির দেওয়াল ও উপরে ছনের ছাউনি দিয়ে যে ঘরগুলো তৈরী করা হতো তা অত্যন্ত আরামদায়ক ছিল কারণ শীতকালে এটি উষ্ণ থাকতো এবং গরমকালে ঠান্ডা থাকতো। শ্রী ইন্দ্রনীল এসোসিয়েটসের প্রধান সংগঠক ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, কালের বিবর্তনে সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে ফলে আগেকার দিনের অনেক জিনিসই আজ বিলুপ্তির পথে। তিনি আরো বলেন, মানুষ এখন উন্নয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে তাই দিন শেষে মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে মাটির ঘরের পরিবর্তে টিন ও ইট-সিমেন্টের ঘর তৈরি করছে। বাংলাদেশ যে উন্নয়েন দিকে এগিয়ে এটি তার জলন্ত দৃষ্টান্ত।
সেওজগাতি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বপন বিশ্বাস বলেন, মানুষের অর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জীবন মানের উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। আর তাই হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালিদের চিরচেনা মাটির ঘরের এই ঐতিহ্য।
গ্রাম বাংলার চির ঐতিহ্যের নিদর্শন চিরচেনা সবুজ শ্যামল ছায়া ঘেরা শান্তির নীর মাটির ঘর। যা এক সময় গ্রামের মানুষের কাছে গরিবের এসি ঘর নামে পরিচিত ছিল। এর সুশীতল ছায়াতলে শান্তি খুঁজত মানুষ। মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে অসংখ্য মাটির ঘর চোখে পড়ত।
অসচ্ছল ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষদের জন্য এটি ছিল একটি আরামদায়ক ও শান্তির নীড়।
এটিতে বসবাস আরামদায়ক হওয়ায় সচ্ছল ব্যক্তিরাও বৈঠকখানা ঘর হিসেবে এটিকে ব্যবহার করে আসছিল। জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই মাটির ঘরের প্রচলন ছিল। মূলত, এটেল বা আঠালো মাটিকে কাঁদায় পরিণত করে দুই থেকে তিন ফুট চওড়া করে শক্ত করে দেয়াল তৈরি করা হতো। ১০-১৫ ফুট দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড়, টালি বা টিনের ছাউনি দেওয়া হত। এটিকে দোতালাও করা যেত। এসব মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের তিন চার মাস সময় লাগত। গৃহীনিরা এসব ঘরের দেয়ালে রঙ-বেরঙের আলপনা একে এটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতেন।
কালের বিবর্তনে তা আজ বিলীন হতে চলেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামেরও। মাটির ঘরের জায়গায় নির্মিত হচ্ছে প্রাসাদসম অট্টালিকা। মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইট-পাথরের দালানকোঠা
মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, প্রযুক্তির উদ্ভাবন, চিন্তা চেতনা ও রুচিবোধের পরিবর্তন,পারিবারিক নিরাপত্তা ও সর্বোপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে এখন আর কেউ মাটির ঘরে থাকতে চায় না। সচ্ছল মানুষেরা ঝুঁকে পড়েছেন ইট পাথরের নির্মিত দালানের দিকে। নগরায়নের সাথে সাথে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নির্মাণ করছেন দালান কোঠা।