গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের ৪৪ মন্ত্রী ও এমপিসহ ৫৯ জন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন এবং তা বিদেশে পাচার করেছেন।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের ভিত্তিতে আদালত এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, একই অভিযোগে শিগগিরই আওয়ামী লীগের আরও অন্তত ২৪ জন মন্ত্রী ও এমপির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করা হবে।
গত এক মাসে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৬ জন সাবেক মন্ত্রী ও ১৮ জন সাবেক এমপি রয়েছেন, যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদের বড় একটি পাহাড় গড়েছেন।
অবৈধ সম্পদের মালিকদের তালিকায় রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ আরও অনেকেই।
এছাড়া সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এবং সাবেক কর কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দুই ডজনের বেশি মন্ত্রী ও দেড় ডজন এমপির বিরুদ্ধে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুদকের প্রাথমিক গোয়েন্দা অনুসন্ধানে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জন এবং তা বিদেশে পাচারের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এ পর্যায়ে তাঁরা বিদেশে গেলে অনুসন্ধান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, সব অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেই বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয় না। সাধারণত যেসব অনুসন্ধান শেষে মামলা করার মতো উপাদান পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেসব ক্ষেত্রে অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়। সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থেই দুদক এটা করে থাকে।
বিদেশযাত্রার নিষেধাজ্ঞায় ৫৯ প্রভাবশালী
দুদক ও আদালতের বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২৭ আগস্ট থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৯টি পৃথক আবেদনে মোট ৫৯ জন প্রভাবশালীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়। এর মধ্যে গত ২৭ আগস্ট এক আবেদনে দুজন, ২৯ আগস্ট এক আবেদনে ১৪ জন, ১ সেপ্টেম্বর পৃথক তিন আবেদনে ৩৬ জন, ১১ সেপ্টেম্বর এক আবেদনে দুজন, ১৭ সেপ্টেম্বর পৃথক দুই আবেদনে চারজন ও ১৮ সেপ্টেম্বর এক আবেদনে একজনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়। আর নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ২৬ জন সাবেক মন্ত্রী ও ১৮ জন সাবেক এমপি রয়েছেন। এ ছাড়া সাতজন সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন এই তালিকায়। বাকিরা মন্ত্রী-এমপিদের স্ত্রী ও সন্তান।
দুদকের আবেদনে যা আছে
আদালতে দাখিল করা বেশ কয়েকটি পৃথক আবেদনে অর্ধশতাধিক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছে। প্রতিটি আবেদনে প্রায় একই ধরনের কথা বলা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়, বিগত সরকারের সাবেক মন্ত্রী এবং বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন রয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এই ব্যক্তিরা দেশ ছেড়ে বিদেশে পালানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা বিদেশ পালিয়ে গেলে অনুসন্ধান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে এবং মামলা হলে পরে রাষ্ট্রের অনুকূলে সম্পদ বাজেয়াপ্ত দুরূহ হয়ে পড়বে।
নিষেধাজ্ঞায় ৪৪ মন্ত্রী-এমপি
দুদক ও আদালতের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২৯ আগস্ট ১৪ মন্ত্রী-এমপি, ১ সেপ্টেম্বর ২৭ মন্ত্রী-এমপি, ১৭ সেপ্টেম্বর একজন এমপি, ১৮ সেপ্টেম্বর একজন মন্ত্রী ও ২২ সেপ্টেম্বর একজন এমপির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন আদালত। তাঁরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান (ঢাকা-১২), সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি (রংপুর-৪), সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪), স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম (কুমিল্লা-৯), সাবেক ধর্মবিষয়কমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান (জামালপুর-২), বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (নারায়ণগঞ্জ-১), যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল (গাজীপুর-২), সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন (পিরোজপুর-২), সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু (কুষ্টিয়া-২), সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম (পিরোজপুর-১), সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক (মানিকগঞ্জ-৩), সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি (চাঁদপুর-৩), সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (চট্টগ্রাম-৯), সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার (নওগাঁ-১), সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ (নরসিংদী-৪), সাবেক শিল্পমন্ত্রী কামাল আহমেদ (ঢাকা-১৫), সাবেক নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান (মাদারীপুর-২), সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম (ঢাকা-২), সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (পার্বত্য অঞ্চল, খাগড়াছড়ি), সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ (ঢাকা-৩), সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ (দিনাজপুর-২), সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক (নাটোর-৩), সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন (কুড়িগ্রাম-৪), সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ (সিলেট-৪), সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ (চট্টগ্রাম-৭), সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ (কালীগঞ্জ গাজীপুর), সাবেক এমপি সলিম উদ্দিন (নওগাঁ-৩), সাবেক এমপি মামুনুর রশীদ কিরণ (নোয়াখালী-৩), সাবেক এমপি কাজীম উদ্দিন (ময়মনসিংহ-১১), সাবেক এমপি নূর ই আলম চৌধুরী (মাদারীপুর-১), সাবেক এমপি মো. জিয়াউর রহমান (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২), ডা. এনামুর রহমান (ঢাকা-১৯), বেনজীর আহমেদ (ঢাকা-১০), কাজী নাবিল আহমেদ (যশোর-৩), মো. মহিববুর রহমান (পটুয়াখালী-৪), শহিদুল ইসলাম বকুল (নাটোর-১), সাবেক এমপি মো. সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (চুয়াডাঙ্গা-১), সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরী (সিরাজগঞ্জ-২), সাবেক এমপি এ কে এম সরোয়ার (কুষ্টিয়া-১), শেখ আফিল উদ্দিন (যশোর-১), সাবেক এমপি মো. এনামুল হক (রাজশাহী-৪), সাবেক এমপি স্বপন ভট্টাচার্য (যশোর-৫), সাবেক এমপি আবু সাঈদ আল মাহমুদ (জয়পুরহাট-২) ও সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন (বাগেরহাট-১)।
সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রী-এমপিদের স্ত্রী-সন্তান
দুদক ও আদালতের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২৭ আগস্ট থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি সাত কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন আদালত। তাঁরা হলেন সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এবং তাঁর স্ত্রী শিরিন আক্তার, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের স্ত্রী লুত্ফুল তাহমিনা খান, মেয়ে সাফিয়া তাসনিম খান, ছেলে শাফি মোদ্দাছির খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মোল্যা নজরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস মনির হোসেন, সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরীর স্বামী মো. শামীম তালুকদার ও তাঁদের সন্তান মুনতাহা রিদায়ী লাম, সাবেক কর কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী ও সাবেক এমপি মো. সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের স্ত্রী আকতারী জোয়ার্দ্দার।
পাইপলাইনে আরো ২ ডজন মন্ত্রী-এমপি
দুদক সূত্র জানায়, ওই ৪৪ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ছাড়াও আরো প্রায় দুই ডজন সাবেক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে আদালতে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হবে। তাঁরা হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান, সাবেক এমপি মো. আবু জাহির (হবিগঞ্জ-৩), সাবেক এমপি মো. শাহীন চাকলাদার (যশোর-৬), সাবেক এমপি এইচ এম ইব্রাহিম (নোয়াখালী-১), সাবেক এমপি নাছিমুল আলম চৌধুরী (কুমিল্লা-৮), সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা (চট্টগ্রাম-৩), সাবেক এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন (বরগুনা-২), সাবেক এমপি আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলিপ (নরসিংদী-২), সাবেক এমপি সাদেক খান (ঢাকা-১৩), সাবেক এমপি গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স (পাবনা-৫), সাবেক এমপি আয়শা ফেরদৌস (নোয়াখালী-৬), সাবেক এমপি রনজিত কুমার রায় (যশোর-৪), সাবেক এমপি মোহাম্মদ হাবিব হাসান (ঢাকা-১৮), সাবেক এমপি নূরুল ইসলাম তালুকদার (বগুড়া-৩), সাবেক এমপি আব্দুল ওদুদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩), সাবেক এমপি জাকির হোসেন (কুড়িগ্রাম-৪), সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান (বগুড়া-৫), সাবেক এমপি মাহবুব আলী (হবিগঞ্জ-৪), সাবেক এমপি মো. আকতারুজ্জামান বাবু (খুলনা-৬) প্রমুখ। সূত্র: কালের কণ্ঠ