বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪ ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামে ৬ মামলা বাতিল   সাবেক সচিব নাসির উদ্দীনকে নতুন সিইসি নিয়োগ   ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন ক্রিকেটার মঈন আলী   বিক্ষোভরত অটোরিকশা চালকদের সেনাবাহিনীর ধাওয়া   জামিন পেলেন সাংবাদিক শফিক রেহমান   রেলপথ মন্ত্রণালয়ে যুক্ত হলো ৫ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট   ছাত্র-জনতার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই: প্রধান উপদেষ্টা   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
গণপূর্তে দুর্নীতিতে তিনি ‘ওস্তাদ’!
আরিফুর রহমান
প্রকাশ: বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৯:০৫ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

কথায় আছে ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয় না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন। যখন যা মন চাইতো তাই করতেন তিনি। এমনই একজন প্রকৌশলীর নাম পবিত্র কুমার দাস। তিনি গণপূর্তে করেছেন ব্যাপক অনিয়ম। 

গণমাধ্যমের আলোচনার শিরোনামে ছিলো তার নাম। ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে মুহূর্তের মধ্যে দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তিনি ছিলেন গণপূর্তের অন্যতম ‘ওস্তাদ’।

সম্প্রতি চলতি বছরের ৪ মে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপির কাছ থেকে লোভনীয় স্থানে যাওয়ার জন্য কোটি টাকার বিনিময়ে পবিত্র কুমার দাস ‘ডিও লেটার’ নিয়েছেন বলে গুঞ্জন আছে। 

চিঠিতে উল্লেখ আছে,পবিত্র কুমার দাস গণপূর্ত (ই/এম) বিভাগ-৬ ঢাকায় কর্মরত আছেন। তাকে ই/এম বিভাগ-৪ ঢাকা বদলী করার জন্য প্রধান প্রকৌশলী বরাবর অনুরোধ করে এই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা।

জানা গেছে, গণপূর্তের প্রকৌশলী পবিত্র কুমার দাস আওয়ামী লীর আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সম্পাদকীয় কমিটিতে ছিলেন। গণপূর্তে চাকরি পাওয়ার পর তার আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। দেশের বাইরে তিনি শতকোটি টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
 
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নানা ধরনের সংস্কারের জন্য মোট ২২টি কার্যাদেশ দিয়েছিল গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর। এর মধ্যে একটি কাজ শেষ করেছেন ঠিকাদার। বাকি ২১টি কার্যাদেশের বিপরীতে কোনো কাজই হয়নি। অথচ এরই মধ্যে সব কাজের ঠিকাদাররা তাদের পুরো বিল তুলে নিয়েছেন। 

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে দেওয়া এক চিঠিতে এমন অভিযোগ করেছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে দরপত্রের মাধ্যমে মোট ২২টি কার্যাদেশ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুসারে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব কাজ সম্পন্ন করে বিল উত্তোলন করবে। 

তবে এক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৬-এর আওতাধীন এই কাজ সম্পন্ন না করেই বিল তুলে নিয়ে ভাগাভাগি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কাজের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী পবিত্র কুমার দাস এবং উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান রনি এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক বলে জানা গেছে। 

২২টি কাজের বরাদ্দ থাকা প্রায় ১০ কোটি টাকা ভুয়া বিল ভাউচারে আত্মসাৎ করেছেন। সুষ্ঠু তদন্ত হলে তারা ফেঁসে যেতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন গণপূর্তের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ২২টি সংস্কার কাজের জন্য আলাদা আলাদা কার্যাদেশ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একটি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সবগুলো কাজ সমাপ্ত হওয়ার প্রত্যয়নপত্র চেয়ে কাগজপত্র দাখিল করে। তবে অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে কাজের প্রকৃত চিত্র উঠে আসায় প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়নি। এরপরও ওইসব কাজের বিল তুলে নিয়েছেন ঠিকাদাররা।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে দেওয়া মুগদা হাসপাতালের পরিচালকের চিঠিতে বলা হয়, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরে গণপূর্ত ই/এম বিভাগ কর্তৃক নির্মাণ/সংস্কার কাজের বিপরীতে ২২টি কাজের প্রত্যয়নপত্রের জন্য কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছে। ওই ২২টি কাজের মধ্যে ২১টির দাখিলকৃত কার্যাদেশ অনুযায়ী কোনো কাজই সম্পাদন করা হয়নি। গণপূর্ত ই/এম বিভাগকে বারংবার বলার পরও তারা নির্মাণ ও সংস্কার কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করছে না।’

জানা গেছে, মুগদা হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ছয় সদস্যের কমিটির সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদনে কাজ না করার বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ২১টি কাজ সম্পন্ন করা হয়নি। 

কমিটির সদস্য এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. আনিছুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা সরেজমিন পরিদর্শনে যে তথ্য পেয়েছি, তা পরিচালক স্যারের কাছে হস্তান্তর করেছি।’

এ বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘যেহেতু আমরা প্রান্তিক ভোক্তা। সেক্ষেত্রে কী কাজ সম্পন্ন হয়েছে সে রকম একটা মতামত দিতে হয়। প্রতিবারের মতোই কাজের সর্বশেষ অবস্থা নিরূপণের জন্য আমাদের একটি কমিটি রয়েছে। ওয়ার্ক অর্ডার এবং সম্পন্ন কাজ দেখে তারা একটি মতামত দিয়েছেন। আমরা লিখিতভাবে ওই বিষয়টা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় টাকা দিয়েছে, বিচারের দায়িত্বও তাদের। আমরা কেবল আমাদের মতামত জানিয়েছি।’

আরও জানা গেছে, ২২টি কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাবর অ্যাসোসিয়েটস, রফিক ট্রেডার্স, অনিক কনসোর্টিয়াম, ব্রাইট ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন, ম্যালার্ড করপোরেশন, স্মাইল এন্টার প্রাইজ, মেসার্স এস এ এন্টার প্রাইজ, মেসার্স জান্নাত এন্টার প্রাইজ, মেসার্স শেখ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স ইউনাইটেড এন্টার প্রাইজ, দিপ্র কনস্ট্রাকশন, মেসার্স জাফির অ্যান্ড ব্রাদার্স, মা-বাবা কনস্ট্রাকশন এবং ওএসএল। 

এর মধ্যে একাধিক কাজ করেছে অনিক কনসোর্টিয়াম এবং বাবর অ্যাসোসিয়েটস। পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদন বলছে, শুধু ব্রাইট ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ২২ লাখ টাকার উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেছে। বাকিরা কেউই কাজ সম্পন্ন করেনি।

জানা যায়, মুগদা হাসপাতালের ওই কাজগুলো ছিল বিভিন্ন অকেজো সরঞ্জাম মেরামত এবং সংস্কার। মেরামত কাজের মধ্যে ছিল হাসপাতাল কম্পাউন্ডে নিরাপত্তার জন্য অকেজো/নষ্ট সিকিউরিটি লাইট, গার্ডেন লাইট, ভবনের চতুর্থতলায় অবস্থিত ফ্লাডলাইট মেরামত বা পরিবর্তনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ। 

এ ছাড়া হাসপাতালের পাম্প মটরের অকেজো নষ্ট যন্ত্রাংশ মেরামত বা পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক কাজও এর আওতাধীন ছিল। আরেকটি কাজ ছিল হাসপাতালের রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের জন্য হাসপাতালে স্থাপিত ২০০ কেভিএ একটি, ২২৫ কেভিএ দুটি এবং ২৫০ কেভিএ একটি অকেজো বা নষ্ট ডিজেল জেনারেটর সেট মেরামত কিংবা সার্ভিসিংসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ। 

এ ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন কার্যাদেশে কনফারেন্স রুমে অকেজো বা নষ্ট বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ফিটিংস ফিকচার মেরামত কিংবা পরিবর্তন; হাসপাতালের পঞ্চমতলার পশ্চিম পাশে স্থাপিত ওয়ার্ডগুলোর অকেজো বা নষ্ট বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ফিটিংস ফিকচার মেরামত কিংবা পরিবর্তন; মেডিকেল কলেজের নবমতলার পূর্ব পাশে স্থাপিত ওয়ার্ডগুলোর অকেজো বা নষ্ট বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ফিটিংস ফিকচার মেরামত কিংবা পরিবর্তন; নিয়ন সাইন বোর্ডে অকেজো বা নষ্ট লাইট পাওয়ার সাপ্লাই মেরামত এবং ৫০০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি জেনারেটর সেটের মেরামত কিংবা সার্ভিসিংসহ বিভিন্ন সংস্কার এবং উন্নয়ন কাজ। 

তদারকির দায়িত্বে থাকা উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এবং নির্বাহী প্রকৌশলীর যোগসাজশে এসব কাজ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার এবং কর্মকর্তা ভোরের পাতাকে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকাকালে তিনি কাউকে পাত্তা দিতেন না। সিনিয়র কর্মকর্তা পবিত্র কুমার দাসকে বেয়াদব বলতেন। তার যা মন চাইতো তিনি তাই করতেন। দেশের বাইরে ‘সেকেন্ড হোম’ করেছেন। পাচার করেছেন শত শত কোটি টাকা। সঠিকভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করলে তার কাছে বিপুল সম্পদ এবং নগদ অর্থ পাবে। 

এ বিষয়ে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান রনি বলেন, ‘মুগদা হাসপাতালের যে কমিটি কাজ পরিদর্শন করেছে, তারা বুঝতে ভুল করেছে। বিষয়টি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মহোদয়কে জানানো হয়েছে। তিনি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আমাদের নিয়ে বসবেন।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে গণপূর্তের (ই/এম) বিভাগ-৬-এর  পবিত্র কুমার দাসের সঙ্গে কথা হলে তিনি ভোরের পাতাকে সবকিছু অস্বীকার করেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি নিয়ম মেনেই সব কাজ করেছি। কোনো দুর্নীতি করিনি।’

‘ডিও লেটার’ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি ভোরের পাতাকে বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না। এটা ভুয়া চিঠি। কে বা কারা এই চিঠি আমার জন্য করেছে আমি জানি না।’ 

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খান ভোরের পাতাকে বলেন, ‘গত কয়েকদিন হলো আমি এসেছি। আপনার কাছে যা শুনলাম এবং চিঠিতে যা অনিয়ম দেখলাম তা সত্যিই দুঃখজনক। এই অনিয়মের বিষয়টি খোঁজ-খবর নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এসব দুর্নীতির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের পাতাকে বলেন, ‘যারা দুর্নীতি করেছেন। তারা এখন অনেকেই সাধু সাজার চেষ্টা করছেন। যারা দুর্নীতি করে দেশটাকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://dailyvorerpata.com/ad/af.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]