দেশে ইলিশের দাম নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে মাছের বাজার সবখানেই চলছে নানা জল্পনা। ভারতে রপ্তানি না করার সিদ্ধান্তের পর অনেকে ইলিশের দাম কমার কথা শুনে বাজারে গিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। ক্রেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে বিক্রেতাদের।
সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, ভারতে ইলিশ না পাঠানো ব্যাপারে সরকারের অবস্থানের কথা জানিয়ে বলেন, আমরা ক্ষমা চাচ্ছি, কিন্তু আমরা ভারতে কোনো ইলিশ পাঠাতে পারব না। এটি দামি মাছ। আমরা দেখেছি, আমাদের দেশের মানুষই ইলিশ খেতে পারে না। কারণ সব ভারতে পাঠানো হয়।
রপ্তানি না হওয়ার পরেও বাজারে ইলিশ মাছের দাম নাগালের মধ্যে না থাকার কারণ হিসেবে এই ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে ইলিশের দাম কমছে না। যার অন্যতম কারণ, যোগানের ঘাটতি।
দেশের ইলিশ রক্ষায় সরকার প্রতি বছর পহেলা মার্চ থেকে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত দুই মাসের মাছ ধরা বন্ধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশের অভয়াশ্রমে মাছ ধরা, পরিবহণ, বিক্রি ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরপর মে-জুন থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইলিশ আহরণের মৌসুম। এই সময়টাকে ‘পিক টাইম’ বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এর বার্ষিক উৎপাদন পাঁচ লাখ একাত্তর হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।
জেলের জালে ধরা পড়া ইলিশ তিন থেকে পাঁচ হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে আসে। এসব জায়গায় দামের তারতম্যের ওপর বাজারও ওঠানামা করে। চাঁদপুরের আড়তগুলোতে মঙ্গলবার সকালে তিন থেকে চারশো গ্রাম ওজনের প্রতি মণ ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার টাকার আশেপাশে; যা কেজি হিসাবে ৬২৫ টাকা করে পড়ে।
প্রায় এক কেজি ওজনের মাছের কেজিপ্রতি দাম উৎসে এক হাজার থেকে ১১০০ টাকা। অর্থাৎ, জেলেরা প্রতি কেজি মাছের জন্য এই দাম পেয়ে থাকেন। আড়তে ওই আকৃতির মাছের দাম ওঠে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা। যা আরো দুই-তিনশো টাকা বেশি দামে কিনতে হয় ভোক্তাকে। রাজধানীর হাতিরপুল বাজারে নয়শো গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের মাছের জন্য ১৮০০ টাকা পর্যন্ত হাঁকছেন বিক্রেতারা।
ইলিশের দাম না কমার কারণ হিসেবে চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি আবদুল বারী জমাদার বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার এই সময়টায় মাছের দেখা মিলছে খুবই কম। ২০২২ সালে প্রতিদিন ১২০০ মণ ইলিশ আসতো মোকামগুলোয়, গত বছর আসে সাত-আটশো মণ আর এইবার আসতেছে দুই-আড়াইশো মণ।
এ বছর ৪০টি ট্রলারে দাদন (অগ্রিম অর্থ) দিয়েছেন জানিয়ে এখন পর্যন্ত একটি ট্রলারও যথেষ্ট মাছ পায়নি বলে দাবি করেন তিনি। জানান, একেকটি ট্রলারে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা করে দিয়েছেন।
এই দাদনদাতাদের মাধ্যমেই জেলেদের মাছ বিক্রির বাধ্যবাধকতা থাকে। এতে কমিশন এজেন্ট হিসেবে তারা দশ শতাংশ অর্থ পান। পর্যাপ্ত যোগান না থাকলে দাম হ্রাসের সুযোগ থাকে না; এমনটাই জানান অন্য ব্যবসায়ীরাও।
আরেকটি কারণ, জেলে ও ট্রলারের খরচ তথা ব্যবসার বিনিয়োগ ও অন্যান্য ব্যয়। ভোলার আড়তদার মো. ইউনুছ মিয়া বলেন, বেচা বিক্রির অনুপাতে খরচও কম নয়। দশ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে ছয় হাজার টাকা খরচ করা লাগে।
আকৃতিভেদে একেকটি ট্রলার বানাতে ব্যয় হয় এক থেকে দেড় কোটি টাকা। সেগুলো দশ বারো বছর পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য থাকে। ফলে, ট্রলারের বিনিয়োগ তুলে আনতে গেলেও মাছের বেচা-বিক্রি ভালো দামে হওয়া জরুরি।
এছাড়া, মাছের বাজারের উচ্চ দামের জন্য কেউ কেউ সিন্ডিকেটের অভিযোগও তুলে থাকেন। তবে, তা অস্বীকার করেন মাছ ব্যবসায়ীরা। তাদরে দাবি, আমরা উন্মুক্ত নিলামে মাছ বিক্রি করি। সিন্ডিকেটের কোনো সুযোগ নেই। তবে জেলেদের জালে মাছ ধরা পড়লে দাম নিজে থেকেই কিছুটা কমে আসবে বলে জানান তারা।