বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকার উত্তরায় আব্দুল আজিজ (৩৫) নামে এক পোশাককর্মীকে হত্যার ঘটনায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ২৭ জনের নামে মামলা হয়েছে।
নিহত আজিজের মা ছায়েরা খাতুন গত ২৮ আগস্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলাটির আবেদন করেন। পরে আদালতের নির্দেশে গত ৯ সেপ্টেম্বর উত্তরা পূর্ব থানা মামলাটি এজাহারভুক্ত করে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট পোশাককর্মী আব্দুল আজিজ উত্তরা হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্সের সামনে গুলিবিদ্ধ হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
এই মামলায় অন্যতম আসামি ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এরইমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশের ৭ দিনের রিমান্ডে আছেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার মহাখালী থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে খিলগাঁও থানায় দায়ের করা ছাত্রদল নেতা জনি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।
উল্লেখযোগ্য অপর আসামিদের মধ্যে আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক হুইপ আবু সাঈদ মাহমুদ স্বপন, সাবেক এমপি মো. জিল্লুর রহমান, সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস, উত্তরার আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন আল সোহেল, দক্ষিণখান ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এস এম তোফাজ্জল হোসেন ও যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার।
আছাদুজ্জামান মিয়া ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।
গত জুন মাসে আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের খবর একের পর এক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর তিনি নতুন করে আলোচনায় এসেছিলেন। সেসময় তিনি দেশের বাইরে অজ্ঞাত অবস্থান থেকে ভিডিও বার্তা দিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে অন্য আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী অনেকের মতো আত্মগোপনে যান আছাদুজ্জামান মিয়া। তার মধ্যেই আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার পরিবারের হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে, শ্যালক ও মেয়ের জামাইয়ের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারি-বেসরকারি ৩০টি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে দুদক।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, ফরিদপুর, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ৭ জেলার সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় ও ভূমি অফিস; ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, নিবন্ধন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক, ৬১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও তফসীলি ব্যাংক, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে তথ্য চেয়েছে দুদক। গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ক্রমান্বয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে দুদকের সংশ্লিষ্ট টিম।
এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর তার ব্যাংক হিসাব ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
গত ১৮ আগস্ট কমিশন সভায় আছাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। পরে ২৮ আগস্ট কমিশনের উপ-পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীরকে প্রধান করে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির আরেক সদস্য হলেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আলিয়াজ হোসেন।
দুদক সূত্র জানায়, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রীর নামে ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুটি ফ্ল্যাট এবং মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ৬৭ শতক জমি রয়েছে। এই তিন জেলায় তার পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে আরও ১৬৬ শতক জমি।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১-এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠা জমির ওপর ছয়তলা একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া গাজীপুরের কালীগঞ্জের চাঁদখোলা মৌজায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সর্বমোট ১০৬ শতক জমি কেনা হয় আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে।
এছাড়া ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় আফরোজার নামে ২৮ শতক জমি কেনা হয়। একই বছর একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনা এবং পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোডে ১০ কাঠা জমি রয়েছে।
এছাড়া পরিবারের সদস্যদের নামে রাজধানীর আফতাবনগরে ৩ নম্বর সেক্টরের এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোডে ২৬ নং প্লটে ২১ কাঠা জমি এবং নিকুঞ্জ-১-এ ছোট ছেলের নামে একটি বাড়ি রয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে তথ্য এসেছে।
পুলিশের চাকরিজীবনে আছাদুজ্জামান মিয়া নানান সময় আলোচিত-সমালোচিত। গত জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুর রহমানের পক্ষে প্রচারণায় তিনি ডিএমপির লোগোযুক্ত (ঢাকা মেট্রো-গ ২৮-৭৪৩৬ নম্বর প্লেট) গাড়ি ব্যবহার করেন বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন।
বিধি অনুযায়ী, কোনো প্রার্থীর পক্ষে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বা গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ নেই। অথচ অবলীলায় সেই কাজটি করেন আছাদুজ্জামান মিয়া। ১৫০০ সিসির গাড়িটি ২০১৯ সালে ৩ সেপ্টেম্বর পুলিশের নামে রেজিস্ট্রেশন হয়।
চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত অফিসিয়াল সুযোগ-সুবিধাকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে ডিএমপির সাবেক এ কমিশনারের বিরুদ্ধে।
এছাড়া ২০১৫-১৬ সালের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন দমানো, বিভিন্ন থানায় হত্যা, গুম, এনকাউন্টারের নামে ক্রসফায়ায়ে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান এসব ঘটনার অন্যতম হোতা বলে অভিযোগ রয়েছে।