‘২০১৫-’১৬ সময়ে যে আন্দোলন হয়েছিল, বিভিন্ন থানায় যত হত্যা, গুম, এনকাউন্টারের নামে ক্রসফায়ার হয়েছিল তার হোতা তিনি। দীর্ঘদিন তিনি ডিএমপির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মিয়া সাহেব হিসেবে পরিচিত। এই আসামি কী পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন জেনে অবাক হতে হবে।’
ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার রিমান্ড শুনানি শেষে তাকে নিয়ে একথা বলেন আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী। খিলগাঁও থানা ছাত্রদল মো. নুরুজ্জামান জনিকে পুলিশ হেফাজতে হত্যার মামলায় গতকাল বৃহস্পতিবার আছাদুজ্জামান মিয়ার রিমান্ড শুনানি ছিল।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক গোলাপ মাহমুদ আসামি আছাদুজ্জামান মিয়ার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিল। আদালত তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ইন্সপেক্টর মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানি করেন। বিএনপিপন্থি আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকীও ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানি করেন।
শুনানিতে আইনজীবী ওমর ফারুক বলেন, ‘এক সময় বেনজীর (সাবেক আইজিপি) দাম্ভিকতার সঙ্গে বলতেন, সরকারের বিরুদ্ধে কেউ আন্দোলন করলে গর্ভ থেকে বের করে এনে গ্রেফতার করা হবে। তিনি দেশে যে পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন তা ভারতের আম্বানির সম্পদের কাছাকাছি। আছাদুজ্জামান মিয়া তারই উত্তরসূরী। তার ভাষাও বেনজীরের মতো ছিল।’
আইনজীবী বলেন, ‘এ আসামি চেয়ারে বসে জনগণকে গুলি করে হত্যা, গুম করেছে। সরকারকে স্বৈরাচার করতে তার মতো কয়েকজন সাহায্য করেছে। কী পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছে পত্রিকায় সিরিজ নিউজ হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা করেন কোথা থেকে এত সম্পদ করেছে। প্রত্যেক সম্পদের পিছে হত্যা, গুম, খুন রয়েছে। মানুষকে ভয় দেখিয়ে প্লট হাতিয়ে নিয়েছে। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় করতো। আসামির দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া দরকার।’
গত বুধবার দিনগত রাতে রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভার এলাকা থেকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) আছাদুজ্জামান মিয়াকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ তাকে জনি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর কথা জানায়।
এদিকে আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে, শ্যালক ও মেয়ের জামাইয়ের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারি-বেসরকারি ৩০টি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর তার ব্যাংক হিসাব ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
গত ১৮ আগস্ট কমিশন সভায় আছাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওযার পর ২৮ আগস্ট উপ-পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীরকে প্রধান করে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির আরেক সদস্য হলেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আলিয়াজ হোসেন।
আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার পরিবারের স্থাবর অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারি বেসরকারি ৩০ প্রতিষ্ঠানে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, ফরিদপুর, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ৭ জেলার সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় ও ভূমি অফিস; ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, নিবন্ধন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক, ৬১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও তফসিলি ব্যাংক, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে তথ্য চেয়েছে দুদক। গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ক্রমান্বয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে দুদকের সংশ্লিষ্ট টিম।
দুদক সূত্র জানায়, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রীর নামে ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুটি ফ্ল্যাট এবং মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ৬৭ শতক জমি রয়েছে। এই তিন জেলায় তার পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে আরও ১৬৬ শতক জমি।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১-এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠা জমির ওপর ছয়তলা একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া গাজীপুরের কালীগঞ্জের চাঁদখোলা মৌজায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সর্বমোট ১০৬ শতক জমি কেনা হয় আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে।
এছাড়া ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় আফরোজার নামে ২৮ শতক জমি কেনা হয়। একই বছর একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনা এবং পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোডে ১০ কাঠা জমি রয়েছে। এছাড়া পরিবারের সদস্যদের নামে রাজধানীর আফতাবনগরে ৩ নম্বর সেক্টরের এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোডে ২৬ নং প্লটে ২১ কাঠা জমি এবং নিকুঞ্জ-১-এ ছোট ছেলের নামে একটি বাড়ি রয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে তথ্য এসেছে।
উল্লেখ্য, ৮৫ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়া ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি ডিএমপি কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন এবং দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান। পরে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এই পদে তার ৩ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।