দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর ২৭ দিনের মাথায় জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করেন। এরমধ্য দিয়ে কিছু সাংবিধানিক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। তার পদত্যাগ নিয়ে কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী।
সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী স্পিকার। সংসদ ভেঙে দিলেও তার পদ যায় না। পদত্যাগ করলেও নতুন স্পিকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত তিনি পদে আছেন বলে ধরে নিতে হয়। পরবর্তী সংসদের সদস্যদের শপথ পড়ানোর ভার তার ওপরই বর্তায়। এমনকি রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে স্পিকারকেই রাষ্ট্রপ্রধানের ভার নিতে হয়।
স্পিকারের পদ শূন্য হওয়ায় এখন পরবর্তী সংসদের এমপিদের শপথ পড়ানোর বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘স্পিকারের পদত্যাগে এক ধরনের শূন্যতা তো তৈরি হয়েছেই। কেন পদত্যাগ করলেন, এটা গ্রহণই বা কেন করলেন। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, কালকে যদি খোদা নাখাস্তা রাষ্ট্রপতি মারা যান বা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন কে?’
সংবিধানের ৭৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- স্পিকারের পদ পাঁচ কারণে শূন্য হতে পারে, যদি (ক) তিনি সংসদ-সদস্য না থাকেন; (খ) তিনি মন্ত্রী-পদ গ্রহণ করেন; (গ) তার অপসারণ দাবি করে সংসদে আনা কোনো প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাস হয়, (ঘ) তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করেন ও (ঙ) কোনো সাধারণ নির্বাচনের পর অন্য কোনো সদস্য তার কার্যভার গ্রহণ করেন।
গত ৬ অগাস্ট রাষ্ট্রপতি যখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিলেন, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর এমপি পদও শূন্য হয়ে গেছে। তাহলে ৭৪ (২) অনুচ্ছেদের ‘ক’ দফা অনুযায়ী তখনই কি তার স্পিকার পদ শূন্য হয়ে গিয়েছিল?
এমন প্রশ্নে জেড আই খান পান্না বলছেন, এক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, পার্লামেন্ট না বসা পর্যন্ত তিনি স্পিকার আছেন। আমাদের কনস্টিটিউশনটা লিখিত। অলিখিত সংবিধানের কিছু অংশ থাকে রিটেন। আবার রিটেন কনস্টিটিউশনের কিছু বিষয় থাকে কনভেনশন। সেটা হচ্ছে, পরবর্তী পার্লামেন্ট না হওয়া পর্যন্ত স্পিকার থাকবেন। তার পদত্যাগের ফলে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এবং এ ধরনের শূন্যতার দৃষ্টান্ত এই প্রথম। সম্ভবত, উপমহাদেশে এই প্রথম।
সংবিধানের ৭৪(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্পিকারের পদ শূন্য হলে বা তিনি দায়িত্বপালনে অসমর্থ বলে সংসদ নির্ধারণ করলে তার সব দায়িত্ব পালন করবেন ডেপুটি স্পিকার।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক (টুকু) গত ১৫ আগস্ট গ্রেফতার হয়েছেন। একটি হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে পুলিশ রিমান্ডেও পাঠিয়েছেন আদালত।
সংবিধানের ৭৪(৩) অনুচ্ছেদ বলছে, ডেপুটি স্পিকারের পদও যদি শূন্য হয়, তাহলে সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধি-অনুযায়ী কোনো সংসদ-সদস্য তা পালন করবেন। কিন্তু এখন তো সংসদই ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
৭৪(৬) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলি সত্ত্বেও ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলিয়া গণ্য হবে।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীও তার উত্তরাধিকার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলে সংবিধানে ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন স্পিকার দায়িত্ব গ্রহণ না করবেন, ততক্ষণ ডেপুটি স্পিকার দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি জেলে আছেন ঠিক, কিন্তু তিনিতো কেবল অভিযুক্ত এখনও। উনি জেলে থাকলেতো সমস্যা নাই। পরবর্তী স্পিকার যিনি আসবেন, তার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, তা গৃহীতও হয়েছে; ডেপুটি স্পিকার জেলে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে কে দায়িত্ব পালন করবেন?
অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন বলেন, এই মুহূর্তে শূন্যতা নাই। রাষ্ট্রপতি যখন থাকবেন না, তখন শূন্যতা আসবে। শূন্যতা তৈরি হলে সেক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইতে হবে। যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় তাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল।