বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের প্রচলন ও জনপ্রিয়তা তৈরি করেছিলেন হাতে গোনা যে কয়জন, তাদের মধ্যে অন্যতম আইয়ুব বাচ্চু। বিশেষ করে রক মিউজিকে তিনি যে পথের সূচনা করেছিলেন, সেই পথ ধরেই হেঁটে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। এক জীবনে যত নন্দিত গান তিনি ভক্ত-শ্রোতাদের উপহার দিয়ে গেছেন, গিটারের যে জাদুকরী সুর ছড়িয়ে গেছেন, তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর।
শুক্রবার (১৬ আগস্ট) ‘গিটার জাদুকর’ খ্যাত এই কিংবদন্তির জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ৬২ পূর্ণ করে পা রাখতেন ৬৩ বছরে।
হয়ত আনন্দ-আড্ডায় প্রিয়জনদের নিয়ে কাটতেন কেক, সিক্ত হতেন অগণিত ভক্তের ভালোবাসায়। কিন্তু ২০১৮ সালেই তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাই ক্যালেন্ডার ঘুরে ১৬ আগস্ট এলেই যেন বিষাদের সুরটা ফের বেজে ওঠে।
জন্মদিন উপলক্ষে আইয়ুব বাচ্চুকে ঘিরে বিশেষ কোনও আয়োজনের খবর পাওয়া যায়নি। তার দুই সন্তান থাকেন বিদেশে। তাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে সংগীতানুরাগীরা পরম ভালোবাসায় তাকে স্মরণ করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বন্দনায় পোস্ট দিচ্ছেন।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। পরিবারের অমত থাকলেও ব্যান্ডের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায় একেবারে শৈশবেই। ছেলের এমন আগ্রহ দেখে ১১তম জন্মদিনে বাবা একটি গিটার কিনে দেন। কিন্তু তখন কি আর কেউ কল্পনা করেছে, এই এগারোর কিশোর একদিন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় গিটারিস্ট ও ব্যান্ড তারকা হয়ে উঠবেন!
কলেজ জীবনে ওঠার পরই বন্ধুদের নিয়ে একটি ব্যান্ড গঠন করেন আইয়ুব বাচ্চু। প্রথমে এর নাম ছিল ‘গোল্ডেন বয়েজ’। পরে অবশ্য নাম বদলে ‘আগলি বয়েজ’ রাখেন। এই ব্যান্ডের গায়ক ছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ। আর গিটারিস্ট ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তারা স্থানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতেন।
১৯৭৭ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন এবি। সেখানে তিনি জেমসের সঙ্গে বাজিয়েছিলেন। তবে আইয়ুব বাচ্চুর উত্থানের সূচনা মূলত ১৯৮০ সালে ‘সোলস’-এ যোগদানের পর। এই ব্যান্ডের হয়ে দশ বছর পারফর্ম করেছিলেন তিনি। অতঃপর ভাবলেন, নিজে কিছু করা যাক। সেই ভাবনা থেকে ১৯৯০ সালে গড়ে তোলেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। যা পরবর্তীতে ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’ বা ‘এলআরবি’ নামে বিপুল খ্যাতি লাভ করে।
ব্যান্ডের হয়ে আইয়ুব বাচ্চু উপহার দিয়েছেন এলআরবি (১৯৯২), সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), ফেরারি মন (১৯৯৬), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০০), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নেই (২০০৫), স্পর্শ (২০০৮) এবং যুদ্ধ (২০১২) অ্যালবামগুলো।
এছাড়া একক শিল্পী হিসেবে তার অ্যালবামের মধ্যে রয়েছে- রক্তগোলাপ (১৯৮৬), ময়না (১৯৮৮), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৮), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কি! (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স (ইন্সট্রুমেন্টাল, ২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯), জীবনের গল্প (২০১৫)। এর বাইরে তার গাওয়া গানের অসংখ্য মিক্সড অ্যালবাম রয়েছে।
আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া অসংখ্য কালজয়ী গানের মধ্যে রয়েছে ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘মেয়ে’, ‘কেউ সুখী নয়’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘এক আকাশের তারা’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘রুপালি গিটার’, ‘উড়াল দেবো আকাশে’, ‘একচালা টিনের ঘর’, ‘তারাভরা রাতে’, ‘বাংলাদেশ’, ‘বেলা শেষে ফিরে এসে’, ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’, ‘আম্মাজান’, ‘ফেরারি মন’ ইত্যাদি।
নন্দিত এই শিল্পীর শ্রদ্ধায় তার জন্মশহর চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে একটি গিটার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ‘রূপালি গিটার’ নামের সেই ভাস্কর্য মাথা উঁচিয়ে এই কিংবদন্তির অবদানের কথা জানান দেয় বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষকে।