স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তিকর, অসম্পূর্ণ ও ভুল তথ্য পরিবেশন করে সুনাম ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত
সরকারি আইন, বিধিবিধান এবং সব ধরনের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রাজধানীর বনানীতে সিটি করপোরেশনের জমিতে পাঁচতারকা মানের হোটেল শেরাটন নির্মাণ করেছে বোরাক রিয়েল এস্টেট কোম্পানি লিমিটেড। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর ও সংস্থার পূর্বানুুমতিও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এরপরও স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তিকর, অসম্পূর্ণ ও ভুল তথ্য পরিবেশন করে হোটেল শেরাটন তথা বোরাক রিয়েল এস্টেটের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে।
পাশাপাশি, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যানের সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে দেওয়া বক্তব্যও স্ববিরোধিতারই বর্হিপ্রকাশ। তিনি বলেছেন, ‘অধিক উচ্চতার শেরাটন হোটেল বিমান ওঠানামার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ।’ তার এ যুক্তি হাস্যকরও বটে। কারণ বেবিচকের অবস্ট্যাকল লিমিটেশন সারফেস (ঙনংঃধপষব খরসরঃধঃরড়হ ঝঁৎভধপব বা ঙখঝ) অনুযায়ী, কনিক্যাল সারফেসের (ঈড়হরপধষ ঝঁৎভধপব) মধ্যে পড়েছে হোটেল শেরাটন। কনিক্যাল সারফেসের উচ্চতা দেওয়া আছে ১৫০-৫০০ ফুট। অর্থাৎ এ সারফেসে ৫০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে হোটেল শেরাটনের উচ্চতা সর্বোচ্চ সীমা থেকে অনেক কম। বেবিচকের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তির এমন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য তাই সুনাম ক্ষুণ্ণ করার পাঁয়তারা বলেই মনে করছে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে হোটেল শেরাটনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যেতে পারে নি¤েœাক্ত তথ্যাদি থেকেওÑওএলএস অনুযায়ী, এয়ার ফার্নেল জোনের মধ্যে এসকেএ টাওয়ার, যেটি বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে। ভবনটির উচ্চতার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ৩০২ ফুট পর্যন্ত। একইভাবে আহমেদ টাওয়ারকে দেওয়া হয়েছে ৩৩৮ ফুট। এটিও বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার দূরে। কুর্মিটোলার লে মেরিডিয়ান হোটেল বিমানবন্দর থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে। তাদের উচ্চতা ২২৫ ফুট। গুলশান-২ এ অবস্থিত ক্রাউন প্লাজা যেটি বিমানবন্দর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে। এর উচ্চতা ৩০২ ফুট। গুলশান-২ এ নির্মাণাধীন হিলটন হোটেলের উচ্চতা দেওয়া হয়েছে ৪৯৯ ফুট। বিমান ওঠানামার ক্ষেত্রে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত পূর্বাচলের লেগেসি টাওয়ার বিমানবন্দর থেকে ৯ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দূরে। এর উচ্চতা দেওয়া হয়েছে ১৫৫২ ফুট পর্যন্ত। শুধু হোটেল শেরাটনকে টার্গেট করে এমন বিভ্রান্তিকর তথ্যের অপপ্রচার থেকেই বোঝা যায়, হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই একটি মহল এমন কা- ঘটাচ্ছে।
ওএলএস অনুযায়ী কোথায় কতটুকু উচ্চতা: স্ট্রিপ রানওয়ে ও রেড জোন শূন্য উচ্চতা; ইনার অ্যাপ্রোচ এলাকায় ০-১৫০ ফুট, আউটার অ্যাপ্রোচ উচ্চতা ১৫০-৫০০ ফুট, ইনার হরিজন্টাল এলাকায় সর্বোচ্চ ১৫০ ফু, আউটার হরিজন্টাল এলাকায় সর্বোচ্চ ৫০০ ফুট, ট্রানজিশনাল সারফেসে ০-১৫০ ফুট এবং কনিক্যাল সারফেসে ১৫০-৫০০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতা অনুমোদিত।
বেবিচক প্রণোদিত ওএলএস অনুযায়ী হোটেল শেরাটন পড়েছে কনিক্যাল সারফেস এলাকায়। এ এলাকার সর্বোচ্চ উচ্চতা নির্ধারিত আছে ৫০০ ফুট পর্যন্ত। সেখানে হোটেল শেরাটনের উচ্চতা ৩০২ ফুট হওয়া সত্ত্বেও একটি মহল অপপ্রচার করছে বলে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। যেহেতু জায়গাটি সিটি করপোরেশনের, তাই আইন অনুযায়ী সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশের (ক্যাব) অনুমতি নেওয়ার কথা নগর কর্তৃপক্ষের। এ ক্ষেত্রে ভবনটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বোরাক রিয়েল এস্টেটের কোনো দায় নেই। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে অংশীদারত্বের চুক্তি সম্পন্ন করে ভবনটির নির্মাণকাজ ২০১৪ সালে সম্পন্ন হয়। তখন এ স্থানটি তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকার মধ্যে ছিল। পরবর্তী সময় ২০১৮ সালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নতুন করে এয়ার ফার্নেল জোন নির্ধারণ করে। এতে কোন এলাকায় কতটুকু উঁচু ভবন নির্মাণ করা যাবে, তার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার কমডোর সাদিকুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভোরের পাতাকে বলেন, রাজউকের কাছে উচ্চতার ক্লিয়ারেন্স জানতে চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো ভবন ভাঙা-গড়া আমাদের কাজ নয়। বনানীর ওই ভবনটি (হোটেল শেরাটন) নিয়ে কোর্টে মামলা চলমান। আমরা কতটুকু উচ্চতা দিয়েছি; তার বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে কিনা, সেটা আদালত ও রাজউক বুঝবে। এয়ার ফার্নেল জোনে অন্যান্য ভবন থাকতেও কেন শুধু শেরাটনকে দায়ী করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।
এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম ভোরের পাতাকে বলেন, এটি সিটি করপোরেশনের জায়গা। তারা অনুমোদন দিয়েছে। এখানে রাজউকের কোনো এখতিয়ার নেই। ভাঙতে হলে সিটি করপোরেশনকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে।
হোটেল শেরাটন ভবনের আদ্যোপান্ত
নকশা অনুমোদন: বুয়েট কর্তৃক ৩০ তলা ভবনের স্ট্রাকচারাল নকশা ভেটিংয়ের পর নিয়ম অনুসারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অথরাইজড অফিসার (প্রধান প্রকৌশলী) তা অনুমোদন করেন। এরপর ৪৪ কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ৬০ কাঠা জমিতে পুরনো চারতলা ভবন ভেঙে ২৮ তলা ভবনটি নির্মাণ করে বোরাক রিয়েল এস্টেট। ২০০৭ সালে বুয়েট ভবনটির অ্যাজবিল্ট আর্কিটেকচারাল ও স্ট্রাকচারাল নকশা ভেটিংয়ের পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
শেরাটন হোটেল নির্মাণে ২০০৭ সালের ২৫ জুন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন অথরাইজড অফিসার কর্তৃক (প্রধান প্রকৌশলী) ৩০ তলা ভবনের নকশা অনুমোদন দেন। এ ছাড়া ২০০৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বুয়েট কর্তৃক ৩০ তলা ভবনের স্ট্রাকচারাল নকশা ভেটিংসাপেক্ষে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালে সিটি করপোরেশন কর্তৃক বিভিন্ন সংস্থা থেকে ৩০ তলার ছাড়পত্র গ্রহণ করা হয় (ডিএমপি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, তিতাস, পরিবেশ অধিদপ্তর, ডেসকো, ঢাকা ওয়াসা ইত্যাদি)। সিটি করপোরেশনের আরএফপি অনুসারে ৬০ কাঠা জমির ওপরই ভবন নির্মাণের জন্য ২০০৪ সালের ১০ এপ্রিল দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরপর ২০১১ সালের ২৭ নভেম্বর ডিএনসিসির তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ১৫ থেকে ৩০ তলার ভবন নির্মাণের বিষয়টি মেয়র কর্তৃক অনুমোদন হয়েছে মর্মে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার সচিবকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করেন।