ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান, পুলিশের সাবেক আইজি বেনজির আহমেদের পর এবার আলোচনায় উঠে এসেছে ঢাকা পাওয়ার ড্রিস্টিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাজিবুল হাদীর নাম। এক সময় বিএনপির রাজনীতি করা হাদী রাজনৈতিক ভোল পাল্টে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়ে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মাত্র ১৬ বছরে কর্মজীবনে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে বনে গেছেন এই কর্মকর্তা।
দুদকে একটি লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, রাজিবুল হাদী বর্তমানে ‘ডিপিডিসি এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন। হাদী যেখানেই যান, গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে অর্থের লোভে চীনাদের হয়ে কাজ করেন। যোগ্য ঠিকাদারের পরিবর্তে অযোগ্যদের সঙ্গে মিলে কাজ করেন। এজন্য কমিশন হিসেবে নেন বিপুল টাকা। জিটুজি’র (সরকারের সঙ্গে সরকারের) মতো স্পর্শকাতর এবং ড্রিম প্রকল্পে দুর্নীতিবাজদের পদায়ন করা নিয়ে এখন জোরালো প্রশ্ন উঠছে প্রকৌশল সমাজে। তারা প্রকল্পের কাজের গুণগত মান, দেশের টাকা সাশ্রয়ের বিষয়েও প্রশ্ন তুলছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যশোরের নাজির, সংকরপুর তার গ্রামের বাড়ি এই প্রকৌশলীর। ২০০৭ সালে তিনি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ডিজাইন পরিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে তার চাকরি জীবন শুরু হয়। ২০০৮ সালের ৯ জুলাই তিনি ডিস্ট্রিবিউশন প্লানিংয়ে (দক্ষিন শাখা) সহকারী ম্যানেজার (নির্বাহী প্রকৌশলী) হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে ডিপিডিসিতে কাজ শুরু করেন। এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে তার ভাগ্যের চাকা। ২০১৪ সালে তিনি সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার (কোম্পানি সেক্রেটারিয়েট) হিসেবে কাজ শুরু করেন। রাজিবুল হাদী ডিপিডিসির খিলগাঁও ডিভিশনে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে ১৭ এপিল ২০১৮ থেকে ৪ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। পরে তাকে ৪ জুলাই ২০১৯ সালে ‘জি টু জি’ প্রকল্পে বদলি করা হয়।
খিলগাঁও ডিভিশনের একটি সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন সময় তিনি গ্রাহকদের সঙ্গে অসদাচরণ, হয়রানি এবং নতুন বিদ্যুৎ সংযোগে গ্রাহকরা ঘুষ না দিলে সংযোগ না দিতে বিভিন্ন রকম টালবাহানা করতেন। পরবর্তীতে হাতে টাকা পেলে সে গ্রাহকের সংযোগ দিতেন। এমনকি, বিদ্যুৎ বিলের কিস্তি করাতে গেলেও তিনি সেখান থেকে উৎকোচ দাবি করতেন।
তারা এ প্রতিবেদককে আরো জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর রেফারেন্সে এক বিদ্যুৎ গ্রাহক উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করলে ওই গ্রাহকের কাছ থেকেও সে পরবর্তীতে এক লাখ টাকা ঘুষ নেয়। এরপর তাকে সংযোগ প্রদান করে। প্রতিনিয়ত এই নির্বাহী প্রকৌশলীর অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তৎকালীন সময়ে কয়েকজন বিদ্যুৎ গ্রাহক তার বিরুদ্ধে বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলে ডিপিডিসির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে প্রধান কার্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিশেষ কারণে তাকে অনিয়মের দায়ে বরখাস্ত না করে খিলগাঁও ডিভিশন থেকে ‘প্রাইজ পোস্টিং’ দিয়ে ‘জি টু জি’ প্রকল্পে বদলি করেন।
সংশ্লিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ২০০৮ সালে দক্ষিণ শাখা ডিস্ট্রিবিউশন প্লানিংয়ের সহকারী ম্যানেজার (নির্বাহী প্রকৌশলী) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ-দুর্নীতি, হুমকি ও অসদাচরণের জন্য রাজীবুল হাদীকে ওএসডি করে টঙ্গী স্টোরে সংযুক্ত রাখে ডিপিডিসি। রাজীবুল হাদীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি জিটুজি প্রকল্পের সব গোপন নথি অর্থের বিনিময় চাইনিজ ও দেশীয় ঠিকাদারদের কাছে পাচার করে দেন। এ কারণে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক কয়েক দফায় তাকে মৌখিকভাবে সতর্কও করেন।
সূত্র বলছে, হাদী চাইনিজ বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন কাজের নকশা, ড্রইং ডিজাইন করে দেন। ডিজাইনে নয়-ছয় করে প্রকল্পের শত শত কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেন। তিনি সম্প্রতি সিনম নামে একটি চাইনিজ কোম্পানিকে দুই শত কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেতে সহায়তা করেন। যার বিনিময়ে তিনি সেখান থেকে ৫ ভাগ কমিশন নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ডিপিডিসির একটি নিভরযোগ্য সূত্র ভোরের পাতাকে জানিয়েছেন, সরকার দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে এই কর্মকর্তা (রাজীবুল হাদী) সংস্থাটিতে অন্য কর্মকর্তাকে জিম্মি করে রাখেন। তার অধীনস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেকের চাকরি খাওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একাধিক প্লট, রূপায়নে ফ্ল্যাট ও যমুনা ফিউচার পার্কে একাধিক দোকান রয়েছে। ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে রয়েছে ফ্ল্যাট রয়েছে। তিনি ডিপিডিসির কর্মকর্তা হয়েও টিবিইএ’র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তার ২টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে এমা কনস্ট্রাকশন ও বেসিক। এই কোম্পানী অন্য নামে নামে থাকলেও মূল মালিক হচ্ছেন রাজীবুল হাদী। যশোরে ও ঢাকায় তার স্ত্রীর নামেও বিপুল পরিমান স্থাবর অবস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।
এইসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাজীবুল হাদীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি, ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও কোনও উত্তর আসেনি।
বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব এবং ডিপিডিসি’র পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এরাদুল হক এ ভোরের পাতাকে বলেন, ‘দুর্নীতি হলে অবশ্যই এই বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হবে। এবং তা প্রমানিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এই বিষয়ে হাদীর দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিসি’র নির্বাহী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মোরশেদুল আলম খান বলেন, ‘আমি অল্প কিছুদিন হয়েছে এখানে এসেছি। বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী এই বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। আমি এইটুকুই বলবো দুর্নীতি হলে অবশ্যই অ্যাকশনে যাব। দায়িত্বশীল যারা আছেন, অবশ্যই এই বিষয়ে দেখবেন। সে যেই কেউ হোক না কেন, যত প্রভাবশালী হোক না কেন ছাড় পাবে না।’
এই বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসির) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ নোমান এর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, ক্ষমতা কখনো চিরস্থায়ী হয় না। আজকে যারা ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে দুর্নীতি করছে তারা কখনো এই দেশের ভালো চায় না। ক্ষমতার অপব্যবহারের চিন্তা মাথায় আসলেই দুর্নীতি হয়। আর দুর্নীতিকে রোধ করতে নিজেদের মনোভাবকে পরিবর্তন করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। না হলে দুর্নীতি বন্ধ হবে না।