জায়গাটা মিরসরাই উপজেলার বড় দরগার হাট অ লের গভীর পাহাড়ি বনজঙ্গলে। খোঁজ পাবার পর হতেই ভ্রমণ পিপাসু মনটা শুরু করল উথালপাথাল। দিনক্ষণ ঠিক করে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র বন্ধুরা একরাতে মাইক্রো’তে করে ছুটলাম। চট্টগ্রাম মহাসড়ক যানজট মুক্ত থাকায় ভোর সাড়ে চারটার মধ্যেই মিরসরাই পৌঁছে গেলাম। গাইড আগেই অপেক্ষায় ছিল।তাকে তুলে এবার কমলদহ ব্রিক ফিল্ডের পাশের সড়ক ধরে, রেল লাইনের দিকে ছুটছি। পথে ব্রেক দিয়ে, প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো চাঁন মিয়া জামে মসজিদে ফজর নামাজ আদায় করে নিই।
এরপর গাড়ি গিয়ে থামল রেল লাইনের ধারে।এবার সারাদিনের জন্য দু পা’ই সম্বল। মেঠোপথ মাড়িয়ে,ক্ষেতের আল ধরে সবুজ পাহাড়ের দিকে হাঁটছি।একটা সময় হারিয়ে যাই পাহাড়ের ভাজে। এটি কমলদহ ট্রেইল নামে পরিচিত। মাত্র ২০/২৫ মিনিট হাঁটতেই ঝরঝরি ঝর্ণা পাই। ঝর্ণাধারাটা খুবই সুন্দর হওয়ায় বর্তমানে অতি উৎসাহী পর্যটকরা রূপসি ঝর্ণা নামে ডাকে। আমরা কিছুক্ষণ সেখানে থেকে,ব্যাতিক্রম কিছু করার ইচ্ছায় ঝিরি পথে না গিয়ে,ঝরঝরির পাশ দিয়ে পহাড়ের ওপর দিকে এগিয়ে যাই। ট্র্যাকিং করে যেতে যেতে অনেক ক্যাসকেড চোখে পড়ে। যেগুলো একেকটা ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্যের। কেউবা ভুল করে ঝর্ণাও ভেবে থাকে।
একটা সময় চোখে ধরা দেয় খুব সুন্দর একটি ঝর্ণা।নাম তার ছাগলকান্দা।গাইডের মুখে নামটা শুনে,মুচকি না হেসে আর পারলাম না। ছাগলকান্দা ঝর্ণাটা বেশ চওড়া। প্রায় ৪০/৫০ ফিট উচ্চতা হতে অবিরাম ধারায় ঝরছে। ইচ্ছে মত চরম গরমে, শীতল পানিতে শরীর ভিজেয়ে নেই। ভেজা শরীরেই সামনে আগাই। সকালে নাশতা না খাওয়ায়, পেটে টান পড়ল কমবেশী সবারই । তাই আর দেরী নয়।জঙ্গল হতে শুকনো লাকড়ী যুগিয়ে,নুডলসের জন্য গরম পানি বসিয়ে দেয়া হল।দে-ছুট এর করিৎকর্মাদের,আগুন জ্বালানোর কেরামতি দেখে,ছোট্ট কালের টিভি সিরিজ ম্যাকগাইভারের কথা মনে পড়ে যায়। ১০ মিনিটের মজাদার নুডলস প্রায় ৪০ মিনিট পর রেডি হল। আহ্ লেট হলেও বেশ টেস্ট ছিল। খেয়েদেয়ে দেহ চাঙ্গা। সল্প সময় হাঁটার পরই, বেশ খাড়া ও পিচ্ছিল পথ সামনে আসে। তাই রিস্ক না নিয়ে রেপ্লিং করে উঠি। যখন অমি উঠি তখন অনেক পর্যটক ক্যামেরা তাক করে ছিল। হয়তো তারা ভাবছিলো লোকটা যখন পড়তে পড়তে মরতে বসবে,তখন সেই সময়ের ভিডিওটা ফেসবুকে আপ্লোড দিয়ে রাতারাতি সুপার হিট হবে। হা-হা-হা।
ঝিরিপথ ধরে হাঁটতে হাটঁতে দুধ রাজ ঝর্ণার দেখা মিলে। প্রত্যেকটা ঝর্ণার নামই ভিন্নরকম আকর্ষণের।এর ভৌগলিক আকৃতিটাও বেশ চমৎকার। যাই এবার মধু খাইয়া ঝর্ণা দেখতে।বুনো পরিবেশে,ঝিরির পানিতে হাইকিং চলছে।চারপাশ নিঝুম নিস্তব্দ একটা ভাব। বিষাক্ত চেলার ছুটেচলা। পা’য়ের নীচে পাথরের ভান্ডার। কোথাও কোথাও দুপাশের গাছ গুলোর ডাল,একটা সাথে অন্যটা এমন ভাবে জড়িয়েছে যে - সুর্যের আলো’ও হার মেনেছে। এপাশটায় সাধারণ পর্যটকদের খুব একটা বিচরণ নেই। আর থাকেই বা কেমনে। দে-ছুট এর দামালরাইত ঝিরির পানিতে, কমবেশী চিৎপটাং খেয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। তবুও ছিল না ক্লান্তি।
হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যাই মধু খাইয়া ঝর্ণা। গা ছমছম করা পরিবেশ। ঝোপঝাড়. জঙ্গল দিয়ে ঘেরা মধু খাইয়া। পাথরের ভাজে ভাজে কলকল শব্দে পানি গড়িয়ে পড়ে।এর দ্বিতীয় ধাপে উঠতে হলে মধু খেয়েই উঠতে হবে! তা না হলে,পা ফসকালেই পগারপাড়। কিন্তু একি হায়,কারো সঙ্গেই মধু নেই। হা হা হা। তাই রেপ্লিং করেই উঠে পড়লাম। ওয়াও! অসাধরণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার মধু খাইয়া। ঝর্ণার ওপর হতে জঙ্গলের রুপ দেখে, বিমোহিত আপনাকে হতেই হবে।দ্বিতীয় ধাপে উঠার পর বুঝতে বাকি রইলা না যে,মধু খাইয়া ঝর্ণার রুপ যতনা না সুন্দর-তার চাইতে অনেক অনেক বেশী দৃষ্টি নন্দন এর অবস্থান। নামের সার্থকতা যাই হোক না কেনো,তবে মধু খাইয়া দেখতে যাবার ট্রেইলটা অসাধারণ ভালোলাগার। এরকম রোমা কর ট্রেইলে অংশ নিতে পারা,ভ্রমণ জীবনে সবার জন্যই হবে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা। মধু খাইয়ার নির্যাস নিয়ে ফিরে আসি, আবারো ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মত থাকা জায়গাতে।কমলদহ ট্রেইলে এরকম অনেক ওয়াই সাদৃশ্য স্থান রয়েছে। যার প্রতিটা ধরে আগালেই প্রকৃতির নানান রুপ চোখে ধরা দিবে। আমরাও যাচ্ছি। বেশ কিছুটা সময় হাইকিং-ট্র্যাকিং করর পর পেলাম, অনিন্দ সুন্দর পাথর ভাঙ্গা ঝর্ণা। তীব্র গতিতে প্রায় ৭০/৮০ ফিট উচ্চতা হতে অবিরাম ধারায় পানির ছন্দপতন।স্ফটিক স্বচ্ছ পানির রঙ অনেকটা নীলাভ। ঝর্ণার আকৃতি অনেকটা ছুড়ির মত। ঝর্ণার সামনে প্রাকৃতিক ভাবেই জলাধার সৃষ্টি হয়েছে। সেই জলাশয়ের শীতল পানিতে মন ভরে ডুবডুবি চলে।সকাল গড়িয়ে বিকেল। তাই আর দেরী না করে, বারৈয়ার ঢালা দিয়ে ফেরার পথ ধরি।
যাবেন কিভাবে: ঢাকা হতে চট্রগ্রামগামী বাসে চড়ে নেমে যেতে হবে মিরসরাই উপজেলার বড় দারোগার হাট। সেখান থেকে সিএনজি/অটো’তে কমলদহ গ্রামের রেল লাইন।
খাওয়া-দাওয়া: তেমন সুবিধা নেই।তাই সঙ্গে শুকনো খাবার রাখতে হবে।
ভ্রমণ তথ্য: সময় নিয়ে ভালোভাবে দেখতে হলে সকাল-সকাল যেতে হবে।সব মিলিয়ে প্রায় ৭/৮ ঘন্টার ট্রেইল।সঙ্গে ভালোমানের রসি রাখুন।
যা করবেন নাঃ খাবার-দাবারের অপচনশীল মোড়ক ফেলে আসবেন না।প্রয়োজনে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলবেন। দক্ষ গাইড সঙ্গে নিন।অন্যথায় হারিয়ে যাবার সুযোগ রয়েছে।