পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী, সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জরুরি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য ফ্রান্স-বাংলাদেশ অভিযোজন চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ যৌথ উদ্যোগ বাংলাদেশের অভিযোজন কৌশলকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি জলবায়ু সহনশীল প্রকল্পগুলির জন্য অতিরিক্ত তহবিল প্রদান নিশ্চিত করবে। গতকাল রোববার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত, মেরি মাসদুপুয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ফ্রান্স-বাংলাদেশ অভিযোজন চুক্তি নিয়ে তাঁর মন্ত্রণালয়ের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠককালে পরিবেশমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
বৈঠকে ফ্রান্স-বাংলাদেশ অভিযোজন চুক্তি চূড়ান্তকরণে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষে জাতীয় অগ্রাধিকারগুলির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বরাদ্দ বিভাজনের অনুরোধ জানানো হয়। চুক্তির সময়সীমা সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে আগস্ট ২০২৮ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। ফরাসি প্রতিনিধি দল বাস্তবায়ন পর্যায়ে বাংলাদেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। আলোচনায় একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যযুক্ত সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রোগ্রামের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। মন্ত্রণালয় প্রাথমিক তহবিল পেতে ন্যাপের ‘ইকোসিস্টেম, ওয়েটল্যান্ড এবং জীববৈচিত্র্য’ খাতের অধীনে প্রকল্প ধারণা জমা দেবে।
২০২৪ সালের জন্য ৪ মিলিয়ন ইউরোর প্রথম কিস্তি নিশ্চিত করতে ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিক প্রকল্প জমা দেয়ার অনুরোধ করে। বৈঠকে সুন্দরবন পুনরুদ্ধার এবং সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রকল্পগুলির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে ম্যানগ্রোভ রোপণ এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক বন অগ্নি ব্যবস্থাপনা। এছাড়াও, ফরাসি সরকার ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে ৩০০ মিলিয়ন ইউরোর জলবায়ু নীতি ঋণ সহায়তা প্রদান করছে। মন্ত্রণালয় বিশেষ সূচকগুলি, বিশেষত বর্ধিত স্বচ্ছতা কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত সূচকগুলি পূরণের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. মোশাররফ হোসেন, অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) ড. ফাহমিদা খানম, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ, যুগ্মসচিব (উন্নয়ন) লুবনা ইয়াসমিন এবং ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সিসিলিয়া কর্টেজ সহ মন্ত্রণালয় ও ফ্রেন্স এম্বাসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
২০২৪ সাল সবচেয়ে উষ্ণতম বছর: বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মকালে ক্রমবর্ধমান তাপদাহের সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ সাল সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হতে চলেছে, সমস্ত জেলায় ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এমন নজিরবিহীন বিপর্যয়ের কারণে দেশের জনসংখ্যা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, হিটস্ট্রোকে কমপক্ষে কয়েকজন ব্যক্তি মারা গেছেন, এবং লক্ষাধিক মানুষ বমি, ডায়রিয়া, তাপ ক্লান্তি, মাথাব্যথা, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, পানিশূন্যতা ইত্যাদ সহ বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়েছেন।
প্রচন্ড তাপদাহের কারণে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই চরম আবহাওয়া বাংলাদেশের পরিবেশের বিপর্যয় এবং দুর্বল পরিবেশগত শাসনের বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন থেকে শুরু করে নদী-খাল দখল ইত্যাদি মানুষ্য ক্রিয়াকলাপ পরিবেশের আজকের অবস্থার জন্য দায়ী।
বিভিন্ন গবেষণায় গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে। হোয়াইট-কলার অপরাধীরা হাজার হাজার একর বনভূমি দখল ও তা উজাড় করেছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানা থেকে ক্ষতিকারক গ্যাস বাতাসকে দূষিত করেছে। শিল্পের বর্জ্রমিশ্রিত পানি নদী দূষণ করেছে। নদীর তীর দখল করে শিল্পকারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশ বিনষ্টের অভিযোগও রয়েছে। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে মারাত্মক দুর্বলতা রয়েছে। পরিবেশগত শাসন, সামগ্রিক শাসনের একটি মৌলিক স্তম্ভ। এটি শুধু জল এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত নয়, এটি জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও জীবিকা, শিল্প ও অবকাঠামো, জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়গুলোর সঙ্গে জটিলভাবে যুক্ত। তবে বাংলাদেশে পরিবেশগত শাসন তার বিচক্ষণ, বিক্ষিপ্ত, পুরানো এবং দুর্বল প্রকৃতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপস্থিতি সত্ত্বেও, তাদের ভূমিকা এবং দায়িত্ব নিয়ে প্রায়শই অভিযোগ উঠে। কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে বাংলাদেশের পরিবেশের এমন বিপর্যয় ঘটছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদী-সম্পর্কিত অবৈধ কর্মকাণ্ড চিহ্নিতকরণ ও মোকাবেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। এমন পরিস্থিতিই বাংলাদেশে মানব-প্ররোচিত পরিবেশগত ক্ষতিকে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়, সহযোগিতা এবং যোগাযোগের অভাব রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে কাজ করে এমন বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়, প্রতিষ্ঠান এবং বিভাগ রয়েছে, তাদের সমন্বয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। উদাহরণস্বরূপ, যখন নদীতে কোনো ঘটনা ঘটে, তখন পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য কে দায়ী হবে তা নির্ধারণ করা কঠি হয়ে পড়ে। ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট ট্র্যাকার এশিয়ার মতে, গত ২০ বছরে দিনের তাপমাত্রা প্রায় ২.৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এছাড়া গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে এবং শীতকালের বিস্তৃতি সংক্ষিপ্ত হয়েছে।
মো. কামরুজ্জামান মিলন, একজন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বর্তমান তাপপ্রবাহকে পরিবেশের বিরুদ্ধে মানুষের কার্যকলাপের পরিণতি বলে মনে করেন। তার পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে দক্ষিণ এশিয়ার তাপপ্রবাহের সঙ্গে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবদান উন্নত দেশগুলোর তুলনায় খুব কম হলেও ক্ষতির শিকার সবচেয়ে বেশি। এককভাবে বাংলাদেশের পক্ষে এ সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়। তাপদাহ কমিয়ে আনতে সরকারকে অধিক উদ্যোগী হতে হবে। পরিবেশ বিধ্বংসী মানব কার্যকলাপ বন্ধে সরকারকে আরো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত যেসব পদক্ষেপের ফলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে।