জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অভ্যন্তরীণ শুদ্ধতা নিশ্চিতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর নজরদারি জোরদার হচ্ছে, নেওয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ।
এনবিআরের অভ্যন্তরীণ তদন্তে প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ইতোমধ্যে অনেকের শাস্তি হয়েছে। এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই কর্মক্ষেত্রে খুব সাধারণভাবে চলাফেরা করেন। অভিযোগ রয়েছে, তারা ব্যক্তিজীবনে আলিশান ফ্ল্যাট ও দামি গাড়ির মালিক, রয়েছে মোটা অঙ্কের ব্যাংক-ব্যালেন্স। এসব কর্মকর্তা কর্মচারীর অনেকে করদাতাদের বিভিন্ন কৌশলে হয়রানি করে তাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে নিজেদের পরিচয় গোপন করে ব্যবসা করেছেন। অনেকে পরিচতজন বা স্ত্রী ও সন্তানের নামেও ব্যবসা করেছেন। অনেকে বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্টেরও মালিক। অনেকের সন্তান বিদেশে নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরে কোটি টাকা খরচ করে পড়াশোনা করেছে বা করছে। অনেকের বিদেশে ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
সূত্র জানায়, মতিউরকাণ্ডের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে- এনবিআরের প্রতিটা কর অঞ্চলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রিটার্নের তথ্য খতিয়ে দেখার জন্য ওই কর অঞ্চলের কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনসদস্যের একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হবে। টাস্কফোর্স খতিয়ে দেখে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির প্রমাণ পেলে তার আয়কর নথি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলে (সিআইসি) পাঠাবে। কারও আয়-ব্যয়ের হিসাবে বড় গরমিল পাওয়া গেলেও তার আয়কর নথি সিআইসিতে পাঠানো হবে।
এ ছাড়া সিআইসি থেকে এনবিআরের সব সদস্য, কমিশনার এবং প্রধান কার্যালয়ের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর রিটার্নের তথ্যও খতিয়ে দেখা হবে। সিআইসিতে বিস্তারিত তদন্ত শেষে কারও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে নিশ্চিত হলে তার যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখানে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেসব কর্মকর্তা কর্মচারীর হিসাবে গরমিল পাওয়া যাবে, তাদের স্ত্রীদের রিটার্নের তথ্য মিলিয়ে দেখা হবে। বিশেষভাবে ব্যাংকে কী পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে এবং তার উৎস কী, তাও খতিয়ে দেখা হবে।
এনবিআর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকগুলোয় এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান, তার দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নামে শতকোটি টাকার বেশি জমা ছিল। গত কয়েক দিনে এসব অর্থের বড় অংশই তুলে নেওয়া হয়েছে।
বেনজীর আহমেদ ও মতিউর রহমান- এ দুজনই ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। বহু বছর ধরে তারা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে আসছেন। ব্যাংক হিসাব খোলার সময় নিজেদের ‘সার্ভিসহোল্ডার’ বা চাকরিজীবী বলে পরিচয় দিয়েছেন। আর তাদের স্ত্রীদের পেশা দেখিয়েছেন ‘গৃহিণী’। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ তারা ব্যাংকে সঞ্চয়ী কিংবা মেয়াদি আমানত হিসাবে জমা রেখেছেন। এনবিআর সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আয়কর রিটার্নে নিজেদের আয়ের উৎস ও সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। ব্যাংক হিসাবে থাকা নগদ অর্থের পূর্ণাঙ্গ তথ্যও তারা দেননি।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ জানান, ‘ভালোমন্দ সব জায়গায় আছে। এনবিআরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকে। এসব অনেকবার এনবিআরের তদনন্তেই ধরা পড়েছে। শাস্তিও দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জানান, ‘এনবিআরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ঘুষ বা অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নিতে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করে থাকে। এতে সৎ ব্যবসায়ীরা ভোগান্তিতে পড়েন। আমার দাবি ব্যবসায়ীদের প্রতি যেমন নজরদারি করা হয় একইভাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপরও নজরদারি করা প্রয়োজন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের গোয়েন্দা শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘ভালোমন্দ সব জায়গায় আছে। মতিউর রহমানের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জন, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠে আসায় ঢালাওভাবে অনেকে আমাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা করছে। এনবিআর তদন্তের মাধ্যমে সৎ-অসৎ চিহ্নিত করলে সুবিধা হবে।’
এনবিআরের অভ্যন্তরীণ তদন্তে অনেকবারই অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী চিহ্নিত হয়েছেন। খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের রাজস্ব ফাঁকির ঘটনার সঙ্গে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গুদাম থেকে স্বর্ণ চুরি এবং ফেনী কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে থাকা অবস্থায় ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা গোলামুর রহমান, মজিবুর রহমান সরকার ও জি এম শাহজাহানকে চাকরিচ্যুত করা হয় এনবিআর থেকে।
মাগুরায় ভুয়া মামলা দেখিয়ে ভিশন ড্রাগস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১ কোটি টাকা ঘুষ দাবি এবং ২০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ভ্যাট অফিসের দুই রাজস্ব কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। বেনাপোল কাস্টম হাউসে চাকরিরত অবস্থায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা খন্দকার মুকুল হোসেনকে প্রায় ২৩ লাখ টাকা পাচারকালে আটক করা হয়। বিষয়টি আমলে নিয়ে এনবিআর এ শুল্ক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে এবং বিভাগীয় মামলা করে।