দেশজুড়ে মাদকের ভয়াবহ বিস্তারের কারণে সরকারি চাকরিজীবী, যানচালক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্য শনাক্তকরণ পরীক্ষা বা ডোপ টেস্ট করার বিষয়টি সম্প্রতি বেশ জোরেশোরে আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্টের বিষয়টি প্রথম থেকেই আলোচনার মধ্যে আছে। এরই মধ্যে গত শনিবার রাতে ঢাকায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের গার্ডরুমের সামনে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ কনস্টেবল কাউসার আলী এসএমজি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে তার সহকর্মী কনস্টেবল মনিরুল ইসলামকে হত্যা করেন। এই গুলিতে জাপান দূতাবাসের গাড়িচালক সাজ্জাদ হোসেন শাখরুখও আহত হন। এ ঘটনায় নতুন করে পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট করার বিষয়টি সামনে উঠে আসে। কিন্তু যে ডোপ টেস্ট নিয়ে এত আলোচনা সেই টেস্টের নীতিমালা এখনো সরকার চূড়ান্ত করতে পারেনি। বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই নীতিমালা আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য গেছে। এদিকে ডোপ টেস্টের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যসহ সরকারি চাকরিজীবীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ওপরও জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ কনস্টেবল কাউসার আলী ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ বলে এই পুলিশ সদস্যের পরিবার দাবি করছে। এতে পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পৃথিবীতে এখন মানুষের মানসিকতার যে পরিবর্তন হচ্ছে এতে সামগ্রিকভাবে আমাদের প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে সজাগ হতে হবে। মানুষের মধ্যে মানসিক বিভ্রান্তি হচ্ছে, তার ব্যক্তিত্বের দূষণ হচ্ছে। মানুষের মধ্যে হানাহানি, দাম্ভিকতা দেখা দিচ্ছে আর্থিকসহ নানা কারণে যা মানুষকে উত্তেজিত করছে। মানুষের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার হার বিভিন্ন কারণে বেড়ে যাচ্ছে এজন্য সরকার, জনসাধারণ ও পরিবারকে সচেতন হতে হবে। এ কারণে এ ধরনের মানুষ আগের মতো আর নিয়মকানুন মেনে চলতে পারছে না। প্রতিটি কর্মস্থল, অফিস-আদালত, থানা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন মানসিক অবস্থাসম্পন্ন লোক যান। সেখানেও যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য তাদের নিয়ন্ত্রণে আমাদেরও দক্ষতা বাড়াতে হবে। এজন্য সরকারকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাৎক্ষণিকভাবে একটি স্কোয়াড তৈরি রাখতে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা), অ্যাডিশনাল ডিআইজি তানভীর মমতাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদকদ্রব্য শনাক্তকরণ পরীক্ষা (ডোপ টেস্ট) বিধিমালা-২০২২ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে তৈরি করে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই নীতিমালা আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য গেছে। এটি পাস না হওয়া পর্যন্ত ডোপ টেস্ট নিয়ে যে ধোঁয়াশা আছে তা কাটবে না। এখন যে যার মতো করে ডোপ টেস্টের কার্যক্রম করছে। দেশে মাদকের বিস্তার রোধে এ-সংক্রান্ত খসড়া বিধিমালা তৈরি করে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। আর এ বিধিমালাটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকারসহ সব প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হবে ডোপ টেস্ট। মূলত ডোপ টেস্টের মাধ্যমে মানবদেহের জৈবিক কিছু নমুনা যেমন- মূত্র, রক্ত, চুল, ঘাম, শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস, মুখের লালা অথবা মানবদেহের যেকোনো অঙ্গ বা অঙ্গের অংশবিশেষ বা দেহ-তরলের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে মাদকের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি যাচাই করা যাবে। মাদকদ্রব্য শনাক্তকরণ পরীক্ষা (ডোপ টেস্ট) বিধিমালা-২০২২টি সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে, চাকরিরত অবস্থায় কারও বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মাদক নিয়েছে মর্মে সন্দেহ হলে, গাড়িচালকের ড্রাইভিং লাইন্সেস দেওয়া ও নবায়নের ক্ষেত্রে, কর্মরত গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে মাদক নিয়েছেন মর্মে সন্দেহ হলে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কেউ মাদক নিয়েছে মর্মে সন্দেহ হলে, বিদেশ গমনে ইচ্ছুক কর্মীদের ক্ষেত্রে, আগ্নেয়াস্ত্র লাইন্সেস দেওয়া ও নবায়নের ক্ষেত্রে, আকাশযান বা নৌযান চালানোর লাইন্সেস দেওয়া ও নবায়নের ক্ষেত্রে এবং প্রয়োজনে সরকার নির্বাহী আদেশে ডোপ টেস্টের নতুন ক্ষেত্র নির্ধারণ করতে পারবে।
বর্তমানে ঢাকাসহ কয়েকটি বিভাগে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে সীমিত পরিসরে ডোপ টেস্টের সুযোগ আছে। তবে দেশে নির্ধারিত কিছু হাসপাতালে পেশাদার যানচালকরা মাদকাসক্ত কি না তা পরীক্ষার জন্য গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন। সেখানে পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই বলে অভিযোগ আছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সদস্যদের মাদকমুক্ত রাখতে ২০২০ সালে ডোপ টেস্ট কার্যক্রম শুরু হয়। এতে প্রথম বছরেই ১২০ জন পুলিশ সদস্যের শরীরে মাদকের উপস্থিতি মেলে। আর পরের তিন বছর মাদক গ্রহণ করেন এমন পুলিশ সদস্য শনাক্ত হন ১৪ জন। ডিএমপি সদর দফতর থেকে জানা যায়, ডোপ টেস্ট শুরুর পর চার বছরে (২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত) শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৪ জন। এর মধ্যে বরখাস্ত করা হয়েছে ১২৪ জনকে। একজন মারা গেছেন। একজন অবসরে। দুজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অন্য ছয়জনের বিরুদ্ধে পদাবনতিসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
তবে শনাক্ত বা শাস্তি পাওয়া সবাই কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার। পুলিশের ওপরের পদের কেউ এ পরীক্ষার আওতায় আসেননি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম রাব্বানী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যারা এলএসডি, আইস জাতীয় মাদক গ্রহণ করেন তাদের একিউট সাইট্রিক ব্রেকডাউন হয়। সে ক্ষেত্রে তাদের আউট অব হাল্যুসিনেশন হয়। যা পজিটিভ সাইন অব মেন্টাল ইলনেস। এ ধরনের মানুষ তার সামনে যে বসে থাকে তাকে শত্রু বলে মনে করে। সে মনে করে কাউকে গুলি করে মেরে ফেললেও কিছু হবে না। কিংবা সেই গুলি তিনি ছুড়ে দিলে কারও ক্ষতি হতে পারে, এই বোধ তার কাজ করে না। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের লোকদের পরিবার ও অফিসের সহকর্মীরা লোকটির আচরণগত সমস্যা টের পেলেই তাকে দ্রুত চিকিৎসা করাবেন বা পুলিশকে খবর দিতে হবে এবং মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে লোকটির কাছে ধারালো বা আগ্নেয়াস্ত্র থাকলে তাকে উত্তেজিত না করে নিরস্ত্র করতে হবে। এরপর চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।