বেশ ভালো একটি খবর চোখে পড়লো সোমবার। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার প্রদান করবে। প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর একজন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থাকে এ পুরস্কার দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে গত অক্টোবরেই একটা উপ-সম্পাদকীয় পাঠ করেছিলাম। লিখেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ দায়েরকারি এবং কলামিস্ট মো. তাঈদ উদ্দিন খান। মাত্র আট মাস যেতে না যেতেই সরকারি ঘোষণা পেয়ে যথেষ্ট স্বস্তি অনুভব করছি।
গত অক্টোবরে অ্যাডভোকেট তাঈদের লেখায় জেনেছিলাম যে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘উপনিবেশবাদী শাসন আর শোষণের নগ্ন হামলাকে প্রতিহত করে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি জাতীয় স্বাধীনতা। তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে শান্তি আর স্বাধীনতা একাকার হয়ে মিশে আছে। আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করি বিশ্বশান্তি আর আঞ্চলিক স্বাধীনতার অপরিহার্যতা।’
তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনে যুক্তদের সহকর্মী হিসেবে অভিহিত করে আরো বলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের।’ বঙ্গবন্ধুর শান্তি দর্শনের মূল সারাংশ এখানেই নিহিত।
একটু পেছনে তাকানো যাক। ১৯০১ সালে যখন নোবেল পুরস্কার চালু হয়, সবাই ভেবেছিলেন সাহিত্যে লিও টলস্টয়ের পুরস্কার নিশ্চিত। কিন্তু, পেলেন সুলি প্রুধোম নামের এক ফরাসি কবি। যিনি ফ্রান্সেই অখ্যাত। টলস্টয় আর পেলেন না। টলস্টয় জীবনকালে অত্যাধিক জনপ্রিয় ও মেধাবী ছিলেন। টলস্টয় ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতিবারই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য এবং ১৯১০ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু একবারও নোবেল পাননি। যা নোবেল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা। রাশিয়ান সাহিত্যের যুগশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের একজন টলস্টয়। ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী।’
পাননি ফিওদর দস্তয়েভস্কি, ম্যাক্সিম গোর্কির মতো কথাশিল্পীরাও। মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টও পাননি। বাঙালিদের জন্য প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র ও পতাকা এনে দেওয়া শেখ মুজিবুর রহমানকেও নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। নোবেল পাননি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও (মহাত্মা গান্ধী), যার আরেক নাম শান্তিবাদী। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হত্যা করা হয় ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে। এর মাত্র দুইদিন পরই ছিল সে বছরের নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন জমাদানের শেষ তারিখ। সেবার নোবেল কমিটি গান্ধীকে মনোনীত করা ছয়টি চিঠি পায়, যার মধ্যে ছিল প্রাক্তন নোবেল লরেট দ্য কোয়েকার্স এবং এমিলি গ্রিন বলচের চিঠিও।
জনাব তাঈদ জানাচ্ছেন, ইতোপূর্বে নোবেল শান্তি পুরস্কার মরণোত্তর কাউকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু নোবেল ফাউন্ডেশনের তৎকালীন সংবিধি অনুযায়ী, কয়েকটি শর্ত মেনে মরণোত্তর শান্তিতে নোবেল দেওয়া যেত। ফলে গান্ধীকে নোবেল দেওয়ারও রাস্তা খোলা ছিল। কিন্তু তারপরও নোবেল কমিটি সে বছর গান্ধীকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়নি। পাঁচবার নোবেল পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হন গান্ধী। ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৪৮ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দুবার। পাকিস্তানের বিখ্যাত ফ্রি অ্যাম্বুলেটরি সার্ভিসের জনক আব্দুল সাত্তার ইদিকেও নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। অন্যদিকে পাশের দেশ ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা দিলীপ কুমার ইউসুফ খানকে ভারতরত্ন সম্মাননা দেওয়া হয়নি। অমিতাভ বচ্চন আজো পাননি এই সম্মাননা। আরো পাননি সুরসম্রাট উস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সাহেব।
পাশের দেশের বঞ্চিতদের তালিকায় সেরা নাম গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, যিনি সম্প্রতি চলে গেলেন। কোনো শ্রেণির উল্লেখযোগ্য সম্মাননাই তার ভাগ্যে জুটেনি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে চতুর্থ ক্যাটাগরির পদ্মশ্রী দেওয়া হলেও তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।
আমরা সবাই জানি স্বীকৃতি ও পুরস্কার আপেক্ষিক। বার্ট্রান্ড রাসেলকে নোবেল দেওয়া হলেও ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি পুরস্কারের জন্য লিখি না।’ ভিয়েতনামের সাবেক প্রেসিডেন্ট লী ডাক থুং শান্তিতে নোবেল পেয়েও নেননি। বলেছিলেন, ‘শান্তি কোথায় ভিয়েতনামে!’ আর নিকট অতীতের বব ডিলানের কাহিনী তো আজ বিশ্বশ্রুত!
লেখক-সাহিত্যিক জাঁ-পল সার্ত্র ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন। কিন্তু তা প্রত্যাখান করতে গিয়ে যে দু-চারটি বাক্য খরচ করেন, তাতেই উপলব্ধি করা যায়, তার ব্যক্তিত্বের আকাশচুম্বী গভীরতা। জাঁ-পল সার্ত্র বলেন, ‘লেখকরা সমগ্র পৃথিবীর, তাদের কোনো প্রতিষ্ঠানের হওয়া উচিত নয়।’
তিনি প্রস্তাবনার সপক্ষে বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। যেমন, বছর দশেক আগে পশ্চিমবঙ্গে এক অসাধারণ উপলক্ষ্যের জন্ম দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অমর কবি আল্লামা ইকবালকে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়েছিলেন তিনি। তারানা ই হিন্দ এবং তারানা ই মিলি রচনার কারণে তাকে এই সম্মাননা জানানো হয়েছিলো প্রায় শতবর্ষ পর। তারানা ই হিন্দ তিনি শুরু করেছেন অসাধারণ বাঙময় জাতীয়তবাদের ধারনা দিয়ে, ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা/হাম বুলবুলেঁ হ্যায় ইস কি ইয়ে গুলসিতাঁ হামারা।’ এর ষষ্ঠ স্তবকে তিনি আরো শক্তিশালী উচ্চারণে এ জাতীয়তা বোধকে আরো উচ্চকিত করেছেন। ‘মাযহাব নেহি সিকাতা আপস ম্যায় বের রাখনা/হিন্দি হ্যায় হাম, ওয়াতান হ্যায় হিন্দুস্তাঁ হামারা।’
তিনি আরো দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে বলছেন, ‘ধর্ম আমাদের নিজেদের মধ্যে কোনো বৈরিতা বা শত্রুতা শিখায় না; আমরা হিন্দি, হিন্দুস্তানই আমাদের দেশ।’ নিঃসন্দেহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। ভারতে এরকম দৃষ্টান্ত আরো আছে। জিন্নাহ’র জীবনী লিখে বিজেপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন বাজপেয়ী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং।
আবার ফিরে আসি জনাব তাঈদের লেখায়। তিনি বঙ্গবন্ধু শান্তি পুরস্কারের একটা রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন উক্ত নিবন্ধে। পুরস্কারের নাম রাখতে চেয়েছিলেন Mujib World Peace Prize (মুজিব ওয়ার্ল্ড পিস প্রাইজ)। ১৯৭১-কে সামনে রেখে এই পুরস্কারের অর্থমূল্য হবে ১৯ লাখ ৭১ হাজার টাকা আর মেডেলের ওজন হবে ৭১ গ্রাম আঠারো ক্যারেট স্বর্ণের। প্রতি বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ শান্তিবাদী নেতা অথবা শিক্ষাবিদ অথবা দার্শনিককে এই সম্মাননায় ভূষিত করা যেতে পারে।
বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ। অনেক আরাধ্য একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটতে যাচ্ছে। তবে পুরস্কারটি এই আলোকে হলে আরো মানানসই হবে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
লেখক : সংস্কৃতিবান ও শিল্প-সমালোচক।