একের পর এক অনিয়ম দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন গণপূর্ত ঢাকা মেট্টো জোনের স্টাফ অফিসার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ। যেখানে চাকরি করেছেন সেখানেই দুর্নীতির রাম রাজত্ব কায়েম করেছেন। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালিন ভুয়া কাজ ও বিল ভাউচারে লোপাট করেছেন ১০ কোটি টাকা। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাঈখের দুর্নীতি তদন্তে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গত ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অধিশাখা-১ এর উপ-সচিব মোসা. সুরাইয়া বেগম এক অফিস আদেশে উচ্চ পর্যায়ের এই কমিটিকে কাজ শুরু করার নির্দেশনা দেন। মন্ত্রণালয়ের ১৫.০০.০০০০.০১৩. ২৭. ০০১. ১০. ১০৯০/১(৪)নং স্মারকে চিঠিতে বলা হয়েছে ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আনীত অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তপূর্বক ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৮ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় তৎকালিন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-২ এর অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ইয়াকুব আলী পাটওয়ারী। সদস্য সচিব করা হয় সিনিয়র সহকারী সচিব তারিক হাসান। তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন জোনের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মো. মঈনুল ইসলাম। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সংস্থাপন) নন্দিতা রানী সাহা ওই বছরের ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর ‘ভুয়া কাজ ও বিল ভাউচারে লোপাট ১০ কোটি টাকার বিষয়ে তদন্ত প্রসঙ্গে’ শিরোনামে তার দপ্তরের ২৫.৩৬.০০০০.২১৩.২৭৫৫৯. ১৯.১০৮৭ নং স্মারকে একটি চিঠি ইস্যু করেন। তদন্তপূর্বক ৩ কর্মদিবসের মধ্যে সুস্পষ্ট মতামত প্রেরণ করার জন্য তদন্ত দলকে নির্দেশ দেন। একই বছরের ৭ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যশোর আঞ্চলিক অফিসের সাবেক উপ-পরিচালক নাজমুস সায়াদাত ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগের ১০ কোটি টাকা লোপাটের বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
ঝিনাইদহে অবস্থানকালে তিনি গণপূর্ত অফিসের ঠিকাদারি কাজের নথি, বিল, ভাউচার দেখেন এবং নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাঈখকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করলেও তিনি শাস্তি পাওয়ার বদলে প্রাইজ পোষ্টিং বাগিয়ে নেন। উল্লেখ্য, ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাঈখ কাজ না করেই কোটি কোটি টাকার বিল উত্তোলন করেছেন বলে বিভিন্ন পত্রিকা ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে খবর প্রচার হয়। দুর্নীতির খবর ফাঁস হয়ে পড়লে তড়িঘড়ি প্রকল্পগুলো আবারও সম্পন্ন করেন।
ঝিনাইদহ শহরের চাকলাপাড়া ডরমেটরি ভবন, নন হেজেটেড ডরমেটরি ভবন, জেলা জজের বাসা, সাব-ডিভিশন অফিস ও গণপূর্তের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর বাসাসহ বিভিন্ন অফিস মেরামত ও রং করেন। অথচ এই সব কাজ সম্পূর্ণ করা হয়েছে দেখিয়ে সেই বছরের জুনের আগেই ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বিল তুলে নিয়েছিলেন তিনি।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ই-জিপি টেন্ডারের মাধ্যমে দরপত্র আহবান করা হয়। কিন্তু বিধি ভঙ্গ করে মেন্যুয়ালি নোটিফিকেশন অফ এওয়ার্ড (নোয়া) দেয়া হয়। যা পিপি’র বিধি বহির্ভূত কাজ। প্রশ্ন উঠেছে ই-জিপি টেন্ডার আহ্বান করলে একজন ঠিকাদার অর্ধশত কাজ কিভাবে পায়? এ ভাবেই তিনি ২/৩টি লাইসেন্সের বিপরীতে ছোট বড় শত শত কাজ পাইয়ে দিয়েছেন, এর মধ্যে কিছু কাজ না করে আবার কিছু কাজ আংশিক করে ৯ কোটি টাকারও বেশি টাকা লোপাট করেছেন। তার এই সব দুর্নীতির মূল সহায়ক হিসাবে সার্বিক সহযোগিতা করেন ঝিনাইদহের তৎকালিন উপসহকারি প্রকৌশলী ফিরোজ আহম্মেদ। সব কাজ পরিচালনা করতেন এবং ভুয়া প্রত্যয়নপত্র বানিয়ে দিয়ে কাজের সমাপ্ত দেখাতেন। এভাবেই দুর্নীতি করে ফিরোজ আহম্মেদও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এত দুর্নীতির পরেও নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাঈখের খুটির জোর কোথায় যে তিনি এখনো পূর্বের মতোই দাপটের সঙ্গে অফিস পরিচালনা করে যাচ্ছেন? নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাঈখ বলেছেন, সাংবাদিকরা যে যাই লিখুক তাতে আমার কিছুই হবে না। আর যত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটিই আসুক না কেন তারা আমার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিবে না।
ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালিন মো. কায়সার ইবনে সাঈখ ২০২১-২২ অর্থবছরে মেরামতের কাজের প্রাক্কলন ও নামমাত্র কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে বিল পরিশোধ করা হয়। ভুয়া কাজ ও বিল ভাউচারে তিনি মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। অনুমোদন পাওয়া প্রাক্কলিত অর্থ কাজে লাগাতে গোপনে কাগজ-কলমে দরপত্র আহ্বান দেখিয়ে কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে দেখাতে হবে জুনের মধ্যেই। তা না হলে বরাদ্দ অর্থ সরকারের কোষাগারে ফেরত যাবে। তাই গোঁজামিল দিয়ে, কখনও কাজ না করেই কাগজ-কলমে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল দিয়ে দেন তিনি। এর প্রমাণও মিলেছে। ঢাকার তেজগাঁও ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের বাংলো-১-এর দরজা, জানালায় থাই গ্লাস লাগানো, টাইলস বসানো, রঙ করা এবং কেন্দ্রীয় রেকর্ড ভবনের পয়ঃনিষ্কাশন লাইন মেরামত ও গ্যারেজ কাম-ড্রাইভার কোয়ার্টারের নিচতলায় গ্যারেজগুলোর সিলিং মেরামত, বিভিন্ন দরজা মেরামত, স্যুয়ারেজ লাইন মেরামত কাজের জন্য ২০২২ সালের গত ৫ জুন ১৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকার একটি প্রাক্কলন অনুমোদন করেন ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক।
কিন্তু অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে অনুমোদন পাওয়া এ কাজ শেষ না করেই বিল পরিশোধের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছেন ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ। নির্বাহী প্রকৌশলী গোঁজামিল দিয়ে কাজ না করেই কাগজ-কলমে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল দিয়ে দেন। গণপূর্ত অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থাপনা মেরামত বা বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (এপিপি) খাতে গণপূর্ত অধিদফতরকে মোট ৮১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে স্থাপনা মেরামতের জন্য আবাসিক ভবনে ৫ হাজার ৯১২টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি এবং অনাবাসিক ভবনে ৬ হাজার ১৭৪টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়।
ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলীর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৬ মে ঢাকার সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবনের ১নং ব্লকের দ্বিতীয় তলায় প্রয়োজনীয় মেরামত ও রঙ করার একটি প্রাক্কলন এবং সেগুনবাগিচায় অডিট কমপ্লেক্স ভবনের তৃতীয় তলায় পূর্ত অডিট অধিদফতরের বিভিন্ন কক্ষে মেরামত ও রঙ করার কাজের আরেকটি প্রাক্কলন অনুমোদন দিয়েছেন ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-১-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।
এনবিআরের প্রশাসন বিভাগের কর্মচারীরা জানান, দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলায় কোনো মেরামত বা রঙ করা হয়নি; বরং এই ভবনের দেয়ালগুলোর অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। একই অবস্থা অডিট কমপ্লেক্স ভবনের তৃতীয় তলা। অডিট অধিদফতরের স্টাফরা জানান, তৃতীয় তলায় কোনো কক্ষে মেরামত ও রঙ করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্ত সার্কেল-২ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক এবং গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ যোগসাজশ করে কাজ শেষ না করেই ঠিকাদারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিল পরিশোধ করেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অফিস কক্ষটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করার বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই কর্মকর্তা দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রায় ১০ মাস আগে কক্ষটির ওয়াশরুমের কমোডসহ ফিটিংস পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং দামি ফার্নিচার কেনা হয়েছিল। প্রথমে দামি টাইলস বসানোর পর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর তা পছন্দ না হওয়ায় আবার তা তুলে দামি পাথর বসানো হয়েছে। এভাবে সরকারি টাকা অপচয় করেছেন এই কর্মকর্তা।
নির্মাণকাজ বন্ধ: নির্বাহী প্রকৌশলীর ঘুষের টাকার দেনদরবার নিয়ে বিরোধের জের ধরে ঝিনাইদহে ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় ঠিকাদার। ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৭ সালে টি. ই অ্যান্ড ইউসিসিজেভি নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ শুরু করে। নির্মাণ কাজের টেন্ডার বাজেট ছিল ৩৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ভেরিয়েশন, রিভাইসড এবং ওপি সমন্বয়সহ মোট নির্মাণ মূল্য ৪৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। কিন্তু বিলের প্রয়োজনীয় অর্থ পরিশোধে ঝিনাইদহের গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাঈখ টাকা ছাড় না করায় নির্মাণকাজ বন্ধ রাখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টি. ই অ্যান্ড ইউসিসি। ঠিকাদারের অভিযোগ নির্বাহী প্রকৌশলীর প্রচণ্ড জেদ ও একগুয়েমি করেই টাকা ছাড় দিচ্ছেন না। যে কারণে ঠিকাদার আর্থিক সংকটে পড়ে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টি. ই অ্যান্ড ইউসিসিজেভির যৌথ ঠিকাদার আশফাক মাহমুদের দাবি এই কাজে তাদের সাড়ে নয় কোটি টাকা পাওনা রয়েছে এবং গ্যারান্টি ও সিকিউরিটি মানি রয়েছে আরো নয় কোটি ৪০ লাখ টাকাসহ মোট প্রায় ১৯ কোটি টাকা। কন্ট্রাক্ট এমাউন্ট হতে মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত বিল তিন কোটি টাকা ছাড়ের অনুমোদন দেয়। নির্বাহী প্রকৌশলী জিদ করেই পেমেন্ট দেয়া বন্ধ রাখে। নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাঈখকে বিলটি পেমেন্ট দেয়ার জন্যে একের পর এক অনুরোধ জানান তিনি।
ঠিকাদার আরো অভিযোগ করে বলেন, এই তিন কোটি টাকা ছাড় দেয়ার জন্য শতকরা ১০ ভাগ টাকা নির্বাহী প্রকৌশলী ঘুষ দাবি করেন। ঘুষের ওই টাকা না দিলে তিনি বিল ছাড় করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। ঝিনাইদহ, কালিগঞ্জ ও হরিণাকুণ্ডে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি মডেল মসজিদ নির্মাণকাজে নির্বাহী প্রকৌশলী মসজিদ প্রতি ৪০ লাখ টাকা করে মোট এক কোটি ২০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। পবিত্র মসজিদের কাজে ঘুষ দিতে ঠিকাদার অস্বীকার করলে হয়রানি করা হয়। মসজিদ তিনটির কাজ কুষ্টিয়া শামীম এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে নিয়ে মল্লিক ব্রাদার্সের মালিক টিপু সুলতান ও পলিট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক আশফাক মাহমুদ সাব ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেন। ঝিনাইদহের সাবেক জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ জানান, ২৫০ বেডের হাসপাতাল নির্মাণ কাজে পিছিয়ে আছে প্রকৌশলীর ঘুষের কারনে। রোগীরা জায়গা না পেয়ে চরম কষ্ট পায়।
সাড়ে ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবনে জীর্নদশা: হস্তান্তরের দুই বছর পার না হতেই ৪৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যায়ে নির্মিত আড়াই’শ বেডের ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল ভবনের টাইলস উঠে যায়। এসির পানি ধরতে বিভিন্নস্থানে পাতা হয়েছে বালতি। অপারেশন থিয়েটারের টাইলস খসে পড়েছে। ভবনের বিভিন্ন দেয়ালে নোনা ধরেছে। মাঝেমধ্যেই অচল হয়ে পড়ছে লিফট। সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার বেশি ব্যায়ে নির্মিত হাসপাতাল নিয়ে চিকিৎসক কর্মচারীদের অভিযোগের অন্ত নেই।
এসব বিষয়ে ৩০০নং স্মারকে অভিযোগ আকারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের অধীনে আট তলাবিশিষ্ট এ হাসপাতাল ভবন নির্মাণের দায়িত্বে ছিল ঝিনাইদহ গণপূর্ত অধিদপ্তর। গণপূর্ত বিভাগ ২০২১ সালের আগষ্ট মাসে ভবন হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। ভবন হস্তান্তরের কিছুদিনের মধ্যেই নির্মানকাজে নানা ত্রুটি ধরা পড়ে। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিব মুহাম্মদ শাহাদত খন্দকার তার দপ্তরের ২৫৩নং স্মারকে গত ৭ এপ্রিল গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে চিঠি দেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরের ইট শুড়কি উঠে গেছে। অনেক জায়গায় টাইলস খসে পড়েছে। নিম্নমানে কাঠ ব্যবহারের ফলে দরজা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। পানির পাইপ ফেটে অনেক স্থানে পানি চুয়াচ্ছে। হাসপাতালের ইন্টারনাল ওয়ারিংয়ে নিম্নমানের তার ব্যবহার করা হয়েছে। জানালা ও বারান্দার গ্লাস ভেঙ্গে পড়েছে। মাঝে মধ্যে লিফট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অপারেশন থিয়েটারের পশ্চিমের ওয়ালের টাইল খসে পড়েছে। ওটি রুমের এসি দিয়ে পানি ঝরছে। এসির নিচে গামলা ও বালতি বসিয়ে রাখতে হয়েছে। অপারেশন থিয়েটারের পাশের রুমের মেঝের টাইলস পুরোটাই উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। গত এক বছরে অন্তত ৭০ বার লিফট বন্ধ হয়েছে। এতে বিভিন্ন তলায় ওঠা-নামায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। গণপূর্ত বিভাগের খুলনার তত্ত্বাবাবধায়ক প্রকৌশলী সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ত্রুটিগুলো ঠিক করে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু মাসের পর মাস পার হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। ঠিকাদার সাইফুল ইসলাম টিপু মল্লিক জানান, তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইটালি ভ্রমণ করে এসি ও লিফট কিনেছেন। এর জন্য তো আমি দায়ী নয়।
আদালতের রায় অমান্য: উচ্চ আদালতের রায়ে প্লটের নামজারি ও আমমোক্তারনামা বাতিল হয়েছে। ওই প্লটের ওপর রয়েছে স্থগিতাদেশ। এরপরও নতুন করে ওই প্লটের মালিকানা হস্তান্তরের সুপারিশ করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩ এর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে উচ্চ আদালতের রায়ের কথা উল্লেখ করলেও অসৎ উদ্দেশ্যে মূল বিষয়গুলো উল্লেখ করেনি। অথচ ওই বিষয়গুলো আমলে নিলে ওই শিল্প প্লটের মালিকানা হস্তান্তরের সুপারিশ করার কোনো সুযোগ নেই। ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে শিল্প এলাকায়। ২৬৬ নম্বরের ৬০কাঠা আয়তনের শিল্প প্লটটির ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করেই এমন সুপারিশ করেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ এবং তেজগাঁও গণপূর্ত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান। আর সে সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এসব কাজে তাদের সহযোগিতা করেছেন তৎকালীন শাখা-১৪ এর দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসচিব মো. শাহিনুর ইসলাম। এ নির্দেশনা ছাড়াও ওই প্লটের মালিকানা বিষয়ে উচ্চ আদালতে তিনটি মামলা চলমান। এরপরও গণপূর্ত অধিদপ্তর ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি অসাধু চক্র উচ্চ আদালতের রায় ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে একটি পক্ষকে মালিকানা হস্তান্তর করতে মরিয়া হয়ে উঠে। বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তারা এসব করেন বলে জানা গেছে। ওই ফাইলের তথ্য গোপন ও জমাকৃত আদালতের কাগজপত্র সরানোর কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন ওই শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মনসুর আলী শাকিদার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর ওই প্লটের বিষয়ে হাইকোর্ট রিট পিটিশন মামলার রায় ঘোষণা করে। আদালতের রায়ের কপি তাদের কাছে থাকার পরও মূল বিষয়গুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি। বরং সেখানে রায়ের খণ্ডিত অংশ উপস্থাপন করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, উচ্চ আদালতের রায়ে বলা মন্ত্রণালয়কে উভয় পক্ষের শুনানি গ্রহণ করে দুই মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিতে বলা হয়েছে। গত বছরের ৩ আগস্ট গণপূর্ত থেকে এই প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার পর অসাধু চক্র বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ফাইল অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, তেজগাঁও শিল্প এলাকার ২৬৬ নম্বর প্লটের দখলদার মো. জিবরান গং। সেখানে তাদের এবং তাদের কাছ থেকে বায়নাসূত্রে মালিকরা পুরো প্লটের দখলে রয়েছেন। এরপরও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সেমিপাকা ফ্যাক্টরি শেডে মেসার্স শওকত আলী অ্যান্ড ব্রাদার্সের পক্ষে নিযুক্ত আমমোক্তার মাইনুল হাসান রুম্মান এবং রাবার প্লাস্টিক তৈরির মেশিন রয়েছে। বাস্তবে যার কোনো সত্যতা নেই। অসাধু চক্র নানা যুক্তি দেখিয়ে জাল-জালিয়াত চক্রের পক্ষে সাফাই গাইছেন।
সম্প্রতি সময়ে বিষয়টি নিয়ে কথা হলে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ এ প্রতিবেদকককে বলেছিলেন, ‘ওই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন তেজগাঁওয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান। পরে তাকে সচিবালয় গণপূর্ত বিভাগে বদলি করা হয়। আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে এমনটি করা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কারও পক্ষে প্রতিবেদন দিই না। কোনো কারণে ভুল হলে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেলে তা সংশোধন করারও সুযোগ রয়েছে।’
সম্প্রতি, একই বিষয়ে গণপূর্তের তেজগাঁওয়ের তৎকালীন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান এ প্রতিবদককে বলেন, ‘ঘটনাটি প্রায় এক বছর আগের। প্রতিবেদনে কী লিখেছি; সেটিও ভুলে গেছি। উচ্চ আদালতের রায় অমান্যের বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি বলেন, মনে করতে পারছি না। আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে এমনটি করা হয়েছে এমন অভিযোগের জবাবে বলেন, এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। যা ঘটনা আমরা প্রতিবেদনে সেটা তুলে ধরেছি। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শাখা-১৪ এর তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপসচিব মো. শাহিনুর ইসলাম একপেশে প্রতিবেদন প্রণয়নে মন্ত্রণালয় থেকে নেতৃত্ব দেন। কাগজপত্র সরানোর কাজে সহযোগিতাকারী ওই শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মনসুর আলী শাকিদার বলেন, ‘কোনো ভুল হলে অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকতে পারে।
শাস্তি শুধুই বদলি: ব্যাপক দুর্নীতি, কাজ না করে বিল উত্তোলন ও ভুয়া বিল ভাউচারে সরকারের কোটি কোটি আত্মসাৎ করার দায়ে ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাইখকে অবশেষে বদলি করা হয়েছে। সচিব পর্যায়ের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটির তদন্তের পরই তাকে ঝিনাইদহ থেকে সরিয়ে চাঁদপুর জেলায় বদলি করা হয়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাহাদাত হোসেন স্বাক্ষরিত ২২৩০নং স্মারকের এক চিঠিতে বলা হয়েছে- আগামী ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে দায়িত্ব বুঝে দিয়ে তাকে কর্মস্থল ত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় ১২ ডিসেম্বর থেকে তাৎক্ষনিকভাবে অবমুক্ত হবেন। এদিকে নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাইখকে বদলির পর ঠিকাদার ও সচেতন মহলের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে প্রমাণিত দুর্নীতির সাজা কি শুধুই বদলী? গত ৩ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ সার্কিট হাউসে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন-২) মো. ইয়াকুব আলী পাটওয়ারীর নেতৃত্বে গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটির সামনে ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাইখের দুর্নীতি ও অনিয়মের একাধিক প্রমাণ হাজির করেন ভুক্তভোগীরা। তাদের ধারণা ছিল প্রমাণিত এসব দুর্নীতির দায়ে সাময়িক বরখাস্ত হবেন কায়সার ইবনে শাইখ। কিন্তু তা না করে তাকে চাঁদপুর জেলায় বদলি করে অভিযোগকারীদের আশাহত করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। উল্লেখ্য ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার ইবনে শাঈখ গত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ই-জিপি টেন্ডার আহবান করে বিধি ভঙ্গ করে মেন্যুয়ালি নেটিফিকেশন অফ এওয়ার্ড (নোয়া) দেন। যা পিপি’র বিধি বহির্ভুত। এতে একজন ঠিকাদারকে অর্ধশত কাজ পেতে সহায়তা করেন। ভুয়া বিল ভাউচার করে প্রায় আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নেন নির্বাহী প্রকৌশলী। কাজ না করেই জুনের আগে কয়েক কোটি টাকার বিল তুলে নেন। একজনের টাকা আরেকজনকে দিয়ে দেন। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে ২৬টি কাজের গোপন টেন্ডার করেন। এ সব বিষয়ে তথ্য ভিত্তিক সংবাদ প্রকাশিত হলে সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এ ব্যাপারে গণপূর্ত ঢাকা মেট্টো জোনের স্টাফ অফিসার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ-এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন না ধরায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এই বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার ভোরের পাতাকে বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।’