বেনাপোল কাস্টমস হাউসের সেই আলোচিত সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরীর সম্পদের হিসাব জানতে চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিনি এখন শুল্ক রেয়াত প্রত্যর্পণ পরিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন।
দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান তদন্ত-২ এর পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশটি বুধবার বেলাল হোসেন চৌধুরীরকে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
দুদকের নোটিশে বলা হয়, ‘প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, আপনি (বেলাল হোসেন) জ্ঞাত আয়ের বহির্ভূত স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ-সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।’
দুদক আইন ২০০৪ এর ধারা ২৬-এর উপ-ধারা (১)-এ অর্পিত ক্ষমতাবলে বেনাপোল কাস্টমস হাউজের সাবেক কমিশনার, স্ত্রীর এবং তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের স্বনামে-বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, দায়-দেনা, আয়ের উৎস ও অর্জনের বিস্তারিত বিবরণী জমা দিতে বলা হয়েছে নোটিশে।
দুদকে পঠানো ওই নোটিশে আরও বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করা না হলে অথবা মিথ্যা বিবরণী দাখিল করা দুদক আইন অনুযায়ী বেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে কিছু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নামে-বেনামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আছে। তার বিরুদ্ধে বাড়ি, গাড়ি ও অবৈধ সম্পদসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর দুদকের হাজির হওয়ার জন্য তলবও করা হয়েছিল।
যদিও অভিযোগগুলো অস্বীকার করে শুল্ক, রেয়াত ও প্রত্যার্পন পরিদপ্তরের মহাপরিচালক বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে আমার বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল। কিন্তু অনুসন্ধানে আমার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ না পেয়ে অভিযোগটি নিষ্পত্তি (নথিভুক্ত) করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, এছাড়া দুদকে দাখিল করা একই ধরনের অভিযোগের বিষয়ে এনবিআর তদন্ত করে। এনবিআরের সদস্য (শুল্কনীতি ও আইসিটি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া স্যারের নেতৃত্বে তদন্ত করেও আমার বিরুদ্ধে কিছুই পাওয়া যায়নি। অভিযোগ আমার নামে যেসব বাড়ি ও ফ্ল্যাটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো অন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে।
তিনি আরও বলেন, দুদকের সাবেক এক উপপরিচালক আহসান আলীর করা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে। আমার আয়কর ফাইলে যা আছে সেটাই আমার প্রকৃত সম্পদ, এর বাইরে আমার কোনো সম্পদ নেই। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দুদক নোটিশ দিয়েছে, আমি আমার সম্পদের হিসাব জমা দেব।
এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি কাস্টমস কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরীর বিরুদ্ধে এনবিআর ও দুদকে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে ৪৮০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির কথা বলা হলেও বিষয়টি তদন্তে সুনির্দিষ্ট বিল অব এন্ট্রি সংক্রান্ত কোনো তথ্য মেলেনি। অভিযোগে শেখ মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নামীয় এক ব্যবসায়ীর মালিকানা হিসেবে মেসার্স ট্রিনা অ্যাসোসিয়েশনের কথা বলা হলেও বাস্তবে ওই ব্যক্তি কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নন।
অবৈধ সম্পদের অভিযোগে বেলাল চৌধুরীর নামে ধানমন্ডির ১৫/এ, রোড নম্বর-৪-এর ১৫ নম্বর বাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়। তদন্তকালে দেখা যায়, ওই বাড়ির মালিক ও বসবাসকারী মো. আতিকুল করিম ও পাপ্পু। ওই বাড়িতে একটি ডেভেলপার কোম্পানি রয়েছে।
এছাড়া অভিযোগে ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডের ১৫ নম্বর বাড়িটি বেলাল চৌধুরীর নামে উল্লেখ করা হয়। তদন্তকালে ওই বাড়ির মালিকানা হিসেবে স্থানীয় তিন ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। এরা হলেন- উজির আফজাল, নাজির আফজাল ও তৈয়ব আফজাল।
ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর বাড়িটিও বেলাল চৌধুরীর নামে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছিল অভিযোগে। কিন্তু এনবিআরের তদন্তে দেখা গেছে- ওই বাড়িটি সাবেক নৌবাহিনীর প্রধান মরহুম মাহবুব আলী খানের নামে। বাড়িটির বর্তমান মালিক সৈয়দ ইকবাল মান্দ বানু। তার দুই মেয়ে জোবায়দা রহমান ও বিন্দু। অভিযোগে বসুন্ধরা জি-ব্লকে ১০ কাঠা জমির ওপর ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের ৬ তলা বাড়ির কথা বলা হলেও ওই তথ্যেরও সত্যতা পায়নি তদন্ত কমিটি।
অভিযোগে বেলাল চৌধুরীর নামে যশোর এসপি অফিসের পাশে ১৫ কাঠা জমির ওপর ১৫ তলা ভবন নির্মাণ, ২ কোটি টাকা দিয়ে সিভিল সার্জন অফিসের পাশে ৩৩ শতাংশ জমি ক্রয় করে ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে ১০ তলা ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়। কিন্তু তদন্তে এর কোনো সত্যতাই মেলেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও নোয়াখালী শহরে ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে ১০ কাঠা জমির ওপর ৬ তলা বাড়ি নির্মাণের যে কথা অভিযোগে বলা হয়েছে, তারও সত্যতা মেলেনি।
আগামী পর্বে: নারীতে বুদ কাস্টমস কমিশনার বেলালের অবৈধ সম্পদের পাহাড়!