চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সাদ মুসা গ্রুপকে ঋণ দিয়ে আদায় করতে পারছে না এক ডজনেরও বেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, ফান্ড ব্যবস্থাপনার অভাব, করপোরেট সংস্কৃতি চর্চার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ডুবতে বসেছে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবসা। দেশের ১৪ ব্যাংক ও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাদ মুসা গ্রুপকে ৩,৫০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়ে এখন আর উদ্ধার করতে পারছে না। এই বিপুল পরিমাণ ঋণের রিসিডিউল করতে সাদ মুসা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ মহসিন এখন নিয়মিত বিভিন্ন ব্যাংকে ধরনা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সাদ মুসা গ্রুপের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের তদন্তে দেখেছে সাদ মুসা গ্রুপ এই বিপুল পরিমাণ ঋণের অপব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ এক খাতের ঋণ অন্য খাতে বিভিন্ন ভাবে অপব্যবহার করেছে।
যে সব ব্যাংকের টাকা নিয়ে এখন আর পরিশোধ করতে পারছে না এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাউথইস্ট ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে উত্তরা ফাইন্যান্স, বিডি ফাইন্যান্স এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, সাদ মুসা গ্রুপ তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। তারা তাদের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। তাদের কর্মকা- সন্দেহজনক কারণ তাদের ঋণ পরিশোধ অনিয়মিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আমরা গ্রুপটিকে একজন খারাপ ক্লায়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করি। একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সাদ মুসা গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রায়ই ব্যাংকের অনিয়মিত ঋণের শ্রেণিবিন্যাসের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আদালতে যান। গ্রুপটি ১১০ কোটি টাকার ঋণের রিসিডিউল করার জন্য আবেদন করার পর, বেসরকারি বাণিজ্যিক সাউথইস্ট ব্যাংক এপ্রিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এনওসি’র (অনাপত্তি পত্র) জন্য আবেদন পাঠিয়েছিল, কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২৬ জুলাই সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম কামাল হোসেনকে একটি প্রত্যাখ্যান পত্র পাঠায়। সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম কামাল হোসেন নিশ্চিত করে বলেন তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি পেয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, সাদ মুসা গ্রুপের মালিক ঋণের অর্থ অনিয়মিত ভাবে ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেড়িয়ে এসছে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিসিডিউল করার জন্য এনওসি দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি সাউথইস্ট ব্যাংকের ১১০.৬০ কোটি টাকা ঋণ রিসিডিউল করতে ডাউন পেমেন্ট হিসাবে ইতোমধ্যে ব্যাংকে ৩.৪৪ কোটি টাকা প্রদান করেছে। সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলছেন ঋণ রিসিডিউল করতে সাদ মুসা গ্রুপকে আগে ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্তে এমন রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের কাছে সাদ মুসা গ্রুপের ৩০০ কোটি টাকার অনিয়মিত ঋণ রিসিডিউল করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এনওসির জন্য অনুমোদন চেয়েছিল কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।
অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামসউল ইসলাম বলেন, তারা এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছে। যদি বাংলাদেশ ব্যাংক আবার তা প্রত্যাখ্যান করে, তখন আমরা ঋণ আদায়ের জন্য সাদ মুসা গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করবো। তিনি বলেন যে ব্যবসায়িক গ্রুপটির ঋণ পরিশোধের আচরণ আগে ভালো ছিল, কিন্তু এখন তারা বিভিন্ন কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঝুঁকি বিবেচনা করে সাদ মুসা গ্রুপের জন্য ঋণ রিসিডিউল সুবিধা বাতিল করেছে কারণ এই ব্যবসা গোষ্ঠীর ঋণ পরিশোধের জন্য নগদ অর্থের প্রবাহ অপর্যাপ্ত। আরেকটি কারণ হলো তহবিল অপব্যবহারে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জড়িত থাকার বিষয়টি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে আসে।
সাদ মুসা গ্রুপের ঋণের রিসিডিউল করতে পূবালী ব্যাংকের এনওসির আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সাফিউল আলম খান চৌধুরী বলেন, সাদ মুসা গ্রুপের ঋণ থেকে আমাদের কোন আয় নেই এবং আমরা গ্রুপের ঋণের বিপরীতে শতভাগ শর্ত রেখেছি। তিনি বলেন, যখন আমরা গ্রুপের ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে যাই, তখনই গ্রুপের মালিক এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ আনতে উচ্চ আদালতে যান। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে, এক ডজনেরও বেশি ব্যাংক ও এনবিএফআই -এর সঙ্গে গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিবি অনুযায়ী মোট ৩৫০০ কোটি টাকা অনিয়মিত হয়েছে। সাদ মুসা গ্রুপের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঋণ গত বছর শেষে ৩৮১ কোটি টাকা ছিল। ব্যাংকের এমডি ও সিইও খোন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, তারা ঋণ শোধ না করায় আমরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সঙ্গে এই ব্যবসায়ি গ্রুপের ঋণ গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে ২৪৬ কোটি টাকা ছিল। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্রুপের এই মুহূর্তে আর্থিক সক্ষমতা অপর্যাপ্ত। তিনি বলেন, গ্রুপটি একটি ছোট পরিমাণ ডাউন পেমেন্ট প্রদান করে রিসিডিউল করতে আবেদন করেছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষে, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফাইন্যান্সের সঙ্গে গ্রুপের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি টাকা।
উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের এমডি ও সিইও এসএম শামসুল আরেফিন জানান, গ্রুপটি সম্প্রতি মাত্র ৬ কোটি টাকা ডাউন পেমেন্ট পরিশোধ করে ঋণ রিসিডিউল করতে আবেদন করেছে। আমরা বলেছি ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ি ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে গ্রুপের ৪০০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে, উত্তরা ব্যাংকে ৭৮ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংকে প্রায় ২৯০ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংকে ৭০ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকে ১৫০ কোটি টাকা এবং প্রাইম ব্যাংকে ১৫০ কোটি টাকা। সাদ মুসা গ্রুপের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের নিকট ঋণ রয়েছে, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক; গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বিডি ফাইন্যান্স এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। এই পাঁচটি ব্যাংক এবং দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রুপের সম্মিলিত অনিয়মিত ঋণেল পরিমাণ ১,৫০০ কোটি টাকারও বেশি।
সূত্র জানায়, ১৯৮২ সালে পোশাক খাত দিয়ে ব্যবসা শুরু করে সাদ মুসা গ্রুপ। চট্টগ্রামের পোশাক খাতের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মহসিন চট্টগ্রাম ফেব্রিকস বোর্ড লিমিটেড, সাদ মুসা ফেব্রিকস লিমিটেড, এমএ রহমান ডায়িং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, সাদ মুসা হোম টেক্সটাইল অ্যান্ড ক্লথিং লিমিটেড, দেশ কম্পিউটার, মার্স অটোমোবাইলস, সাদ মুসা হাউজিং কমপ্লেক্স লিমিটেড, হাসনি বনষ্পতি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, আল মুস্তফা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আহমদি অয়েল মিলস লিমিটেড, ক্রিসেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রোকেয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেড, এমদাদ এতিমিয়া স্পিনিং মিলস লিমিটেড, সুলতান হাবিবা ফেব্রিকস লিমিটেড, মাহমুদ সাজিদ কটন মিলস লিমিটেড, সায়মা সামিরা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, কর্ণফুলী জুট ট্রেডিং একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।