মানবিক সংগঠন সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা পারভেজ হাসান, থাকেন মানুষের পাশে। যেখানে দেখতে পান অসহায়ত্বের ছাপ ছুটে চলেন সেখানে। গভীর রাত ঘুরে পুরো ঢাকার শহরের পথশিশু ও রাস্তায় ঘুমানো মানুষদের মাঝে খাবার বিরতণ করেন নিয়মিত। মানুষের কল্যাণে ছুটে চলা এই তরুণের বেড়ে ওঠা ছিল কঠিন। আছে এক অপ্রিয় জীবন সংগ্রামের গল্প।
কিছুদিন আগে এক পথশিশুর সাথে কথা হয়। গল্পেরছলে জানতে পারি সে ক্ষুধার্ত, আমার কাছে খাবার চাইলো, খাবার দিলাম। কথা বলে জানতে পারলাম তার বাবা মারা গিয়েছে, মা অন্য কোথাও বিয়ে করে চলে গিয়েছে এখন তার খোঁজ নেন না। ছেলেটা মায়ের জন্য প্রতিরাতে কাঁদে কেউ খাবার দিলেও গিলতে কষ্ট হয়। এই শহরে তার কেউ নেই, এটা ভাবলেই সে হতাশ হয়। আমি যখন মুখে খাবার তুলে দিচ্ছিলাম, ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো, আমি চোখ মুছে দিতেই বাচ্চাটি আমাকে বলে উঠলো আমি আপনাকে বাবা ডাকতে পারি? আমি উত্তর দিলাম অবশ্যই। আলাপচারিতায় এমনটিই জানাচ্ছিলেন পারভেজ হাসান।
এক সময় পারভেজের জীবন কাটে হতাশায়, পারভেজ এখন ঘুরে দাড়িয়েছেন। মানুষের আস্থা ও ভরসাস্থল হয়েছেন। পারভেজ এর ফেসবুক পেইজে আপলোড দেয়া ভিডিওতে দেখা যায়, পারভেজ এর গাড়ি দেখেই তাকে চিনে ফেলেন শহরের পথশিশুরা। ডাকতে থাকে পারভেজ ভাইয়া বলে।
পারভেজ এর শৈশব কাটে নানা বাড়িতে। পরিবার থাকতো ঢাকায়। স্কুলে ভর্তি করানোর কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় তাকে। পড়াশোনা ও খেলাধুলায় পারদর্শী ছেলেটিকে দেওয়া হয় মামার চায়ের দোকানে। সেখানে বন্দিজীবন অসহ্য লাগে তার। এসব দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার ভূত চাপে মনে! ১২ বছর বয়সে আত্মহত্যা করার মতো সিদ্ধান্ত নেন আজকের এই পারভেজ। চায়ের দোকানের পাশের ব্রিজে উঠে লাফ দেবেন, এমন সময় ছুটে আসে সমবয়সীরা পথশিশুরা। তাদের মধ্যে একজন ধরে নামায়। আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের শুরু হয়।
পারভেজ মামার চায়ের দোকানে কাজ করার সুবাদে খাওয়া-থাকার জায়গা পায়, কিন্তু পথশিশুরা তা-ও পায়না। তাহলে তিনি ওদের থেকে ভালো আছেন। এটা ভেবে পারভেজ নিজে থেকে কিছু করার চিন্তা করেন। দোকানের পাশে টেনিস ও গলফ ক্লাবে বলবয় হিসেবে ৫০ টাকা পেতেন। গ্যালারিতে চা-কফি বানানো থেকে শুরু করে সব করতেন। অনেকে খুশি হয়ে টাকা দিতেন। টাকা জমিয়ে ১৪ বছর বয়সে দেন চায়ের দোকান। কিছুদিন পর চটপটির দোকান দিয়ে ভালো আয় করতে থাকেন। শেষে ফাস্ট ফুডের ব্যবসায় জড়ান পারভেজ। দিনদিন উন্নতি হতে থাকে। ব্যবসার পাশাপাশি নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করতে থাকেন।
এরপর পারভেজ চিন্তা করলেন, অসহায় মানুষের জন্য কিছু করবেন। তখন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে যাকে পেতেন; তাকেই নিয়ে যেতেন। ধানমন্ডিতে গেলেই পথশিশুদের খাওয়াতেন। একদিন এক পথশিশু ফুটপাতে অসুস্থ মায়ের মাথায় পানি ঢালছে দেখে পারভেজ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। কিছুদিনের মধ্যে তিনি সুস্থ হন। মাথায় পানি ঢালার দৃশ্যটি ভিডিও করে রাখেন। রাতে ফেসবুকে শেয়ার করে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে উঠে দেখেন লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের বন্যায় ভেসে গেছে ভিডিও।
ভার্চুয়াল দুনিয়ায় দারুণ প্রশংসা কুড়ান। তখনকার কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসন ওই পরিবারের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন। নেটওয়ার্ক বড় হওয়ায় গুছিয়ে কাজ করবেন বলে ভাবেন পারভেজ। শুরু হয়‘সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন’র পথচলা। এই মানবিক সংগঠনের উদ্যোগে এখন দেশের বিভিন্ন জায়গাতে গিয়ে পাশে দাড়িয়েছেন মানুষের, বন্যা কবলিত এলাকায় খাবার বিতরণ থেকে শুরু করে মানুষের অসহায়ত্বের কথা শুনলে ছুটে দেশের আদ্যপ্রান্তে ছুটে যান এই তরুণ। এমনকি সহযোগিতা পাঠিয়েছেন ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিধস্ত এলাকার শিশুদের জন্য।
জীবন সংগ্রামী পারভেজ বলেন, বাংলাদেশে ৬ লাখ পথশিশু, শুধুমাত্র ঢাকার শহরেই ৭৫% শিশুর বসবাস। এরা সবাই বিপদগ্রস্থ, থাকার কোনো জায়গা নেই, নেই খাবারের নিশ্চয়তা, একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে এদের জীবন। আমি যখন এদের কাছে যাই এদের গল্পটা শুনি, বন্ধুর মত আচরণ করে এদের কষ্টগুলো বুঝার চেষ্টা করি, প্রাই সব শিশুর গল্পটা যেমন একই থাকে। কারো মা নেই, কারো বাবা নেই। কারো আবার কেউ-ই নেই। আবার দেখা যায় এমনো শিশু আছে যারা জানেনই না তাদের মা বাবাকে। যে সময়টা অন্যান্য শিশুদের মত হেসেখেলে তাদের জীবন অতিবাহিত করার কথা সেই সময়টা তারা জীবনের সাথে লড়াই করে কাটাতে হচ্ছে, খাবারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে আমার আপনার কাছে, কেউ দয়া করে দিলে খায় না দিলে না খেয়েই কাটাতে হয় জীবন।
আমরা যখন সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রাতের খাবার দেই, তখন জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগ শিশুর এক-ই উত্তর থাকে সেই দুপুরে খেয়েছি তারপর সারাদিন না খাওয়া। বেশিরভাগ সময় রাতের বেলাটা ওরা না খেয়ে ঘুমাতে হয়, আবার এখন তো লকডাউন এই মহূর্তে অদের জীবন আরো করুণ, দিনের বেলাও খাবার পাচ্ছেনা। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি রাতের বেলা খাবার দেওয়ার সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।
পারভেজ আরও বলেন, বেশিরভাগ পথশিশু ড্যান্ডি নামক মাদকসহ অন্যান্য খারাপ কাজে লিপ্ত হচ্ছে। যাদের বয়স একটু বেড়ে যাচ্ছে তারা একটা সময়ের পর ছিনতাইকারী হচ্ছে, মানুষের ক্ষতি করছে। আর এটা করার পিছনে কিন্তু দায়ী আমরাই, কারণ আমরা তাদের অবহেলার চোখে দেখি, মানুষ হিসেবে গণ্যই করিনা।
এমনকি তাদের সাথে হাসিমুখে কথাও বলিনা, আমাদের ভেতর আচরণে পরিবর্তন আনা জরুরি, সুযোগ দেওয়া উচিৎ। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে পুরো ঢাকারশহর ঘুরার চেষ্টা করি, বিভিন্ন স্থানের পথশিশুদের সাথে আমাদের সখ্যতা আছে, আমরা তাদের বন্ধু হয়েছি ধীরেধীরে এদের থেকে বাছাই করে কিছু শিশুকে আমরা পরিচর্যা করে সুন্দর জীবন ফিরে পেতে সহযোগিতা করেছি। আমাদের রাতের খাবার প্রজেক্ট চলমান, তা ছাড়াও আমরা খাবারের পাশাপাশি যাদের পড়নে কাপড় নেই তাদের পোশাক দিচ্ছি, কেউ অসুস্থ হলে তাকে তাতখনিক চিকিৎসা দিচ্ছি। আমার ইচ্ছে আছে এই পথশিশুদের জন্য আশ্রায়ণ প্রকল্প করার, যেখানে এই বিপথগামী শিশুরা থাকা ও পড়াশোনার পাশাপাশি পাবে নিরপাদ জীবন।
পারভেজ এর সংগঠন সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের সারা দেশের ৩১টি জেলায় তাদের টিম রয়েছে। শুরুর দিকে রাস্তায় পড়ে থাকা অজ্ঞাতনামা বা অসহায় অসুস্থ মানুষদেরকে সেবা দিয়ে (৮৪ জনকে সেবা দেয়া হয়) তাদের বাসায় বা আত্মীয়স্বজনদের নিকট পৌঁছে দেয়ার কাজ করলেও ধীরে ধীরে কাজের ব্যপ্তিটা বেশ বড় হতে থাকে। এরপর যুক্ত হয় রক্তদানের কার্যক্রম। "হাসির দোকান" প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ হাজার শিশুকে ইতোমধ্যে তাদের পছন্দ অনুযায়ী নতুন পোশাক দেয়া হয়েছে।
"ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম" প্রকল্প দেশের যেকোনো জরুরি মহুর্তে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা করোনা মহামারীতে কাজ করে। ঘূর্ণিঝড় আ¤ফানের সময় বন্যা কবলিত জেলাগুলোয় দীর্ঘ ১০০ দিন ব্যাপী প্রায় এক লাখ মানুষকে প্রতিদিন রান্না করে খাওয়ানো হয়। এছাড়াও অসহায় পরিবারগুলোর মাঝে কাঁচা বাজার, সুপ্রিয় পানির ব্যবস্থা, টিউবওয়েল ও পাকা টয়লেট স্থাপন, শিশুখাদ্য, শিশুদের জন্য নতুন বই এবং নারীদের জন্য ১৫ হাজার স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করে সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন। গত বছরের করোনার শুরু থেকে প্রায় ১০হাজার পরিবারকে নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারসহ অসংখ্য মানুষকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ও অক্সিজেন সেবা দিতে সক্ষম হন তারা।
এছাড়া কর্মেই হোক দিন বদল নামক প্রকল্পের মাধ্যমে অসহায় পরিবার, বিধবা নারী বা বেকার যুবকদের আত্মকরর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সেলাই মেশিন, হাস মুরগি গরু, ছাগল প্রদান করা হয়। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় ৩০০জন সুবিধা ভোগ করছে। পাশাপাশি হাতিরঝিলের আশেপাশে যেসব ছেলেরা নেশাগ্রস্থ তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে ১২১ জন ছেলে মেয়েকে বিনামূল্যে শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাদ্যের ব্যবস্থাসহ তাদের উপার্জনক্ষম করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে পারভেজ।
ভোরের পাতা/কে