ছয় দফা শুধু বাঙালির মুক্তি সনদ নয়, ছয় দফা ছিল পাকিস্তানের সকল বঞ্চিত জাতিগুষ্টির ম্যাগনাকার্টা
আজ ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস। প্রথমেই গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ছয়দফার প্রবক্তা ও রচয়িতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ছয়দফা আন্দোলনের শহিদ মনু মিয়া সহ নাম না জানা শহীদদের।
অনেকে বলে থাকেন যে ছয়দফা তৎকালীন সিএসপি রুহুল কুদ্দুস, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান প্রমুখরা প্রনয়ন করেছেন। আবার জাসদ সমর্থক কিছু অর্বাচীন ব্যক্তি ইনিয়েবিনিয়ে গাঁজাখুরি কথা বলে থাকেন যে, আসলে ছয়দফা খসড়া করে দিয়েছেন সিরাজুল আলম খান। অথচ জাতির জনক যখন ছয়দফা প্রনয়ন করেন তখন রাজনৈতিক ময়দানে সিরাজুল আলম খানদের জন্মই হয়নি। রুহুল কুদ্দুস সহ কিছু বাঙালী অর্থনীতিবিদ ছয়দফাতে ঘষামাজা করে কিছু বিষয় সংযোজন করেছেন মাত্র, কিন্তু মূল ছয়দফা বঙ্গবন্ধুর ব্রেন চাইল্ড। তিনি নিজেই এর মুল খসড়া করেন। আবার ছয়দফাকে অনেকে বলে থাকেন যে, এটা বাঙালীর মুক্তি সনদ, কেউ বলেছেন "বঙ্গবন্ধু বলেছেন " এটা বাঙালীর মুক্তির সাঁকো।
কিন্তু জাতির জনকের আত্মজীবনী সহ বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের উপর দেশ বিদেশের বিশেষ করে পাকিস্তান, বাংলাদেশের রাজনীতিক, কলামিস্ট এবং কিছু পাকিস্তানী জেনারেল ও এয়ার মার্শালদের লেখা বই,কলাম যতটুকু পড়েছি এবং বিভিন্ন টকশোতে তাদের কথাবার্তা শুনেছি এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে আইউবের সংলাপ পড়ে, যেমন একটি গোল টেবিল বৈঠকে আইউব খান বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিল "শেখ সাহেব আপনি কি একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার চান? বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন " মিস্টার প্রেসিডেন্ট আমি একটি শক্তিশালী গনতান্ত্রিক পাকিস্তান চাই, কিন্তু শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার নয় । কেন্দ্রের হাতে থাকবে শুধু পররাষ্ট্র, অর্থ ও প্রতিরক্ষা। বাকি সব থাকবে প্রাদেশিক সরকার বা রাজ্যে সরকারের হাতে।
যাইহোক, সবকিছু পড়ে শুনে এবং বিশ্লেষণ করে তাতে আমার মনে হয়েছে যে, ছয়দফা শুধু বাঙালীর মুক্তি সনদ ছিলনা ছয়দফা ছিল সমগ্র পাকিস্তানের সকল জাতি গুষ্টি, সকল ধর্মীয় ও নৃগোষ্ঠী অর্থাৎ বাঙালী, পান্জাবী, পাঠান,বেলুচী, সিন্ধী, শোষিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির ম্যাগনাকার্টা বা মুক্তি সনদ। পাকিস্তানি বাইশ পরিবার সহ ধনিক শোষক শ্রেনী ও তাদের রক্ষক জেনারেলেদের হাত থেকে সমগ্র পাকিস্তানের সকল জাতি গুষ্টির গরীব, দূঃখি, শোষিত নির্যাতিত মানুষের মুক্তি সনদ ছয়দফা। সেই জন্য আমার কাছে মনে হয়, শেখ মুজিবের বিশালত্বের তুলনায় " বঙ্গবন্ধু" উপাধিটি অতি নগন্য মনে হয়। যদিও উপাধিটি তার নামের সাথে একাকার হয়ে গেছে, তবু এটা সত্য যে, তিনি শুধু একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী বা একটি ভূখণ্ডের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেন নাই। তার দর্শন ও সাধনা ছিল,তার সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল শোষিত মানুষের সার্বিক মুক্তি। তাই আমি বিশ্বাস করি যদি ছয়দফা বাস্তবায়ন হতো তাহলে বাংলাদেশের জন্ম হতোনা। কিন্ত সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে শাসন ক্ষমতার দন্ডমুন্ড পান্জাবীর হাত থেকে বাঙালীর হাতে চলে আসতো এবং পাকিস্তান হতো দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী গনতান্ত্রিক দেশ। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রানহানী হতোনা, নষ্ট হতোনা কোটি কোটি টাকার সম্পদ। কিন্তু পাকিস্তানী রক্ত শোষা ধনিক শ্রেণী ও তাদের দূর্নীতিবাজ জেনারেলরা তা মেনে নিতে পারেনি। কারণ তাদের শোষনের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে, পাকিস্তানে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামন্ত সমাজ ব্যবস্হা ভেঙে পরবে। তাই তারা তাদের শ্রেণির প্রতিনিধি সিন্ধুর ভূস্বামী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে দিয়ে "পিপিপি" নামক দল সৃষ্টি করে ও জামাতে ইসলামি সহ অন্যান্য সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ দলগুলোর মাধ্যমে ভারত বিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালিয়ে ধর্মের আফিম খাওয়াইয়া পশ্চিমা সাধারণ মানুষকে ছয়দফাকে ভারতের ষড়যন্ত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদের পরিকল্পনা বলে বিভ্রান্ত করে। ৭০এর সাধারণ নির্বাচনে ছয়দফার স্বপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ট জনগন রায় দিলেও পাকিস্তানী শোষক গুষ্টির সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে সুদীর্ঘ বছর ধরে শোষন, বঞ্চনা অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাঙালীর মনের মৌলিক পরিবর্তন ঘটে এবং ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় এবং ছয়দফা পরিনত হয় এক দফায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
ভোরের পাতা/কে