প্রায় আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটারের কক্সবাজার জেলার একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে, ছোট বড় কয়েক শ’ পাহাড়। আর সরকারি এসব জমি অবৈধ দখল করে বসবাস করছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। তার মধ্যে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে প্রায় ৩ লাখের বেশি। এতে গত ১০ বছরে কক্সবাজার জেলায় একাধিক পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় ছয় সেনাসদস্যসহ প্রায় ৩শ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভায় প্রাণহানি ৯৮ জন। প্রতিবছর পাহাড় ধ্বসে হতাহতের ঘটনা দীর্ঘ হলেও পাহাড় খেকোদের দৌরাত্œ থামাতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নেই কোন কার্যকর প্রদেক্ষেপ। তবে সারাবছর ঘুম থাকলেও বর্ষা আসলে তাদের লোকদেখানোর কিছু তৎপরতা দেখা যায়।
অন্যদিকে, কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির লোকজন বলছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এর সৎ ইচ্ছে না থাকলে পাহাড় খেকোদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এতে পাহাড়ের পাদেদেশে অবৈধ স্থাপনা দিন দিন যেমন বাড়বে তেমিন প্রতিবছর পাহাড় ধ্বসে মৃত্যুর মিছিলও লম্বা হবে। অতি ঝুঁকিতে থাকাদের প্রাণহানী এড়াতে তাদের অন্য জায়গায় পুনর্বাসনের জন্য তাগিদ দেন তাঁরা। যদিও বা সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের পূর্ণবাসনের কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে গত কয়েক দিন ধরে কক্সবাজারে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। এতে ইতো মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের শরনার্থী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৃথক পাহাড় ধসের ঘটনায় উখিয়ার ময়নার ঘোনা ১২ নম্বর ক্যাম্পের রফিক উল্লাহ ও টেকনাফ চাকমারকুল ২১ নম্বর ক্যাম্পের নুর হাসিনা (২০)সহ ২ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় ৪ জন। এভাবে শুধু কক্সবাজার শহরে ৪০ হাজার মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া পাহাড়ধসে ঘরবাড়ি বিলীন হওয়ার পাশাপাশি কক্সবাজার শহরসহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সড়ক যোগাযোগও।
এদিকে স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক শ্রাবস্তী রায় ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জাহিদ ইকবাল জানিয়েছেন “টানা প্রবল ভারী বর্ষণে পাড়ারধ্বসে আশংকা রয়েছে। যার কারণে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের নিয়ে জরুরী সভা করেছে তাঁরা। সভায় পাহাড়ধ্বসসহ অন্যান্য দূর্যোগ মোকাবেলা করতে ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে সরাতে সেল্টারগুলো খোলা রাখা হয়েছে। সিপিপি, রেডক্রিসেন্ট এর স্বেচ্ছাসেবক টিম প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি ফায়ার সার্বিস, পৌরকাউন্সিলরসহ অন্যান্যরাও প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া সকল উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)দেরও দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অফিসের সাথে সমন্বয় রেখে রোহিঙ্গা ক্যম্পেও ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে”।
কক্সবাজার বন বিভাগ সুত্রে জানা যায়, বন বিভাগের ৯ হাজার ৬৫৭ হেক্টর বনভূমি অবৈধ দখলে রয়েছে। সরকারি এসব জমি দখল করে বসবাস করছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম আসলেই কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা এসব লোকজনকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। মাইকিং করে সতর্কমূলক প্রচারণা চালান। পরে আবার এসে আগের জায়গায় বসবাস শুরু করে।
কক্সবাজার বন বিভাগের সূত্র আরো জানায়, জেলায় মোট বনভূমির পরিমাণ ৭৩ হাজার ৩৫৮ হেক্টর। এরমধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে ৯ হাজার ৬৫৭ হেক্টর বনভূমি। এর মধ্যে পাহাড়ি জমিতেই বসবাস করছে ১৩ হাজার ৮২৬টি পরিবারের তিন লাখ মানুষ। জেলার মোট জনসংখ্যা ২৩ লাখ।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাহাড় ধসে গত ১০ বছরে ৬ সেনা সদস্যসহ ৩ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮ সালের ৪ ও ৬ জুলাই টেকনাফে ফকিরা মুরা ও টুন্যার পাহাড় ধসের একই পরিবারের চারজনসহ ১৩ জন, ২০১২ সালে ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় ২৯ জন, ২০০৯ সালে চকরিয়া, উখিয়া ও রামুতে ৫ জন, ২০১০ সালের ১৫ জুন রামু উপজেলার হিমছড়ি এলাকার ১৭ ইসিবি সেনা ক্যাম্পের ৬ জন সেনা সদস্যসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মারা যায় প্রায় ৬২ জন প্রাণ হারায়। ২০১১-২০১৩ সালে পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে ১৯ জন, ২০১৫ সালে কক্সবাজার শহরের রাডারের পাহাড় ধসে মা-মেয়ে সহ ৫ জন ২০১৬ সালে পাহাড় ধসে মারা যায় ১৭ জন, এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে কক্সবাজর দরিয়ানগরে র্ঝণায় গোসল করতে গিয়ে পাহাড় ধ্বসে ঢাকা ইউনির্ভাসিটির দুই শিক্ষার্থী মারা যায়।
এদিকে প্রতি বছর পাহাড় ধসে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়লেও সেদিকে কোন খেয়ালই নেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী এসব মানুষের। স্থায়ী ঠিকানার অভাব বা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বাধ্য হয়েই এসব স্থানে বসবাস করছেন করছেন বলে জানান তারা। তাদের বক্তব্য “মরলেও পাহাড়ে মরবো, বাঁচলেও পাহাড়ে বাঁচবো”
ফাতেরঘোনার পাহাড়ে তৈরি একটি ঘরের মালিক ছমুদা খাতুন (৫৫)। তাঁর বাড়ি মহেশখালী। পাহাড়ে পাদদেশের ঘরে থাকেন স্বামী ও চার ছেলেমেয়ে। তিনি বলেন, সমুদ্রের প্লাবনে মহেশখালীতে নিজের ভিটেমাটি বিলীন হয়েছে, তাই তিনি পরিবার নিয়ে এই পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ৩০ হাজার টাকায় একখণ্ড পাহাড়ি ভূমি কিনে তৈরি করেছেন একটি টিনের ঝুপড়িঘর।
বৈদ্যঘোনা পাহাড়ের ঢালুতে ঘর তৈরি করে বসতি করছেন সাধন দত্ত। তিনিও পাহাড় ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে নারাজ। তাঁর ভাষ্য, ‘অনেক কষ্টে ঘরটি তৈরি করেছি। ঘরটি ফেলে অন্যত্র চলে গেলে এটি অন্যরা দখল করে নেবে। তখন মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে না।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কক্সবাজার শহর ও আশপাশের এলাকায় নানা কৌশলে চলছে পাহাড় কাটা। পাহাড় কেটে এসব এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। শহরের আলোচিত ও বহু মামলার আসামী পাহাড় খেকোদের সর্দার ইলিয়াছ ও সিআইপি ইদ্রিস টিএনটি পহারসহ আশপাশের শতশত পাহাড়ি এলাকা দখল করে গড়েছে বহু স্থাপনা। এছাড়া কক্সবাজার শহরের ঘোনার পাড়া, মোহাজের পাড়া, বৈদ্যঘোনা, বইল্যাপাড়া, জাদি পাহাড়, খাজা মঞ্জিল এলাকা, বাদশাঘোনা, ফাতেরঘোনা, ইসলামপুর, হালিমা পাড়া, লাইট হাউজ পাড়া, সার্কিট হাউজ সংলগ্ন এলাকা, আবু উকিলের ঘোনা, রহমানিয়া মাদ্রাসা এলাকা, পাহাড়তলী, বাঁচা মিয়ারঘোনা, হাশেমিয়া মাদ্রাসার পেছনে, সাহিত্যিকা পল্লী, বিডিআর ক্যাম্পের পেছনে, লারপাড়া, সদর উপজেলা কার্যালয়ের পেছনে, পাওয়ার হাউস, লিংকরোড, কলাতলী বাইপাস সড়কের দুই পাশের বিশাল পাহাড়ি এলাকা, হিমছড়িসহ জেলা শহরের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। এছাড়া কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ, রামু, সদর উপজেলা, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে অবৈধ বসতি। এসব বসতিরা রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা কার্যালয় সূত্র জানায়, পৌরসভার অভ্যন্তরে ১২টির বেশি পাহাড়ে ভূমিধসের ঝুঁকিতে আছে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। এসব পাহাড়ে ১২ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি তৈরি করে বসতি করছে আড়াই লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে অন্তত ৮০ হাজার মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, “গত ১০ বছরে কক্সবাজার শহের একাধিক পাহাড়ধসের ঘটনায় ছয় সেনাসদস্যসহ অন্তত ৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার মধ্যে ২ জন ঢাকা ইউনির্ভাসিটির ছাত্রও রয়েছে। আর প্রায় জেলায় ৩ শতধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এরপরও বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী অন্তত ৪০ হাজার মানুষকে সরিয়ে আনা যাচ্ছে না”
জেলার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, “কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করা প্রায় ৩ লাখ মানুষ রয়েছে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে। আর পাহাড়ে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা নেওয়ার এখনো কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তবে ঝুঁকিতে থাকাদের সরিয়ে নিতে কাজ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি জন্য নানা কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে”
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শেখ মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, এ পর্যন্ত পাহাড় কর্তন কারীদের বিরুদ্ধে ২শটি মামলা হয়েছে। এছাড়া ২০২০ এর জানুয়ারী থেকে এ পর্যন্ত ২৫০টি ক্ষতিপূরণ মামলা হয়েছে।
‘পাহাড় কাটা রোধে অভিযান ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি চলমান রয়েছে। প্রতিদিনই কোনও না কোনও এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে। পাহাড় খেকোদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা হচ্ছে।’তবে, জনবল সংকটের কারণে অভিযান একটু ব্যাহত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
কক্সবাজার স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক শ্রাবস্তী রায় জানান, পাহাড়ে অবৈধ বসতি ও পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন, বনবিভাগ, পরিবেশ অধিদফতর, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে ২০১৮ সালে একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল এবং বেসরকারি সংস্থাসহ অন্যন্যদের সহযোগিতা একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। তবে অনেকেই বদলিজনিত কারণে এটি হালনাগাদ করা হবে। তবে এখনও যারা রয়েছে, তাঁরা অবৈধ বসতি ও পাহাড় কাটা রুধে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এছাড়া কয়েকদিনের টানা বর্ষণে বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাকারিদের সরিয়ে যেতে মাইকিংসহ অন্যান্য কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।