
দেশে প্রকাশন শিল্প এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আজো তার অবস্থান শক্ত করতে পারছে না। অথচ এই প্রকাশন শিল্পের বয়স কিন্তু কম নয়। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানতে পারা যায়, দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রথম প্রকাশন শিল্প গড়ে উঠে। তার আগে ১৯৪৭ সালে রংপুরে গড়ে উঠে রংপুর বার্তাবহ। সে হিসাবে এই বঙ্গে প্রকাশন শিল্পের বয়স প্রায় ৭৪/৭৫ বছর হতে চলল। কিন্তু এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেও কেন প্রকাশন শিল্প তার শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি? এটা প্রশ্ন থেকেই যায়। স্মরণ করা যায়, ১৯৮১ সালে ইস্ট পাকিস্তান পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন ভেঙ্গেই কিন্তু বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির যাত্রা শুরু হয়। ঠিকানা ছিল লিয়াকত ৩, এভিনিউ। যা পূর্বে ইস্ট পাকিস্তান পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন এর অফিস রুপে ব্যবহার হত। লক্ষ্যনীয় দিক হল, এ সেক্টরের ব্যবসায়ীদের ব্যপকভাবে সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিক্রেতাদেরকেও সমিতিতে আনা হয়েছিল। দৈনিক যুগান্তরের ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এর রিপোর্টে জানা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় ৩৮ জন প্রকাশক নিয়ে সমিতির যাত্রা শুরু হয়।
কিন্তু, যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে তারা সংঘবদ্ধ হলেন, তার কতটুকু তারা অর্জন করতে পেরেছেন? না কি পারেন নি? যদি না পেরে থাকেন তবে তার কারণ কি? সেই উত্তরগুলোই খুঁজবো আমরা। সমিতির উদ্দেশ্য ছিল-
সম্মিলিত নিরাপত্তা, কার্যকরীভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থের উন্নয়ন, দেশের অর্থনীতি ও কল্যাণে বিশেষ অবদান রাখার উদ্দেশ্যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদক্ষ ও প্রগতিশীল কর্মতৎপরতার জন্য প্রকৃত প্রকাশক ও বিক্রেতাদের একত্রিকরণ। জাতীয় শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উন্নয়ন। সমিতিভুক্ত সদস্যদের অধিকতর ও যৌথ স্বার্থ সংরক্ষণ, সরকার ফেডারেশন, বাণিজ্যিক ও শিল্প সমিতিসমূহ এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ ও সহযোগিতা রক্ষণের মাধ্যমে সমিতির সদস্যদের স্বার্থ অর্জনের জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশ ও বিক্রয় সমিতির নামে অভিযোগ উঠে যে সব ধরনের প্রকাশকদের নিয়ে কাজ করার জন্য সৃজনশীল প্রকাশকদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমিতির পক্ষ থেকে যথার্থ কর্মকাণ্ড ছিল না । ফলে কতিপয় সৃজনশীল প্রকাশকরা আলাদা নিবন্ধিত সমিতি গঠন করে, যার নাম হয় বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। মোটা দাগে এই সংগঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল-
সৃজনশীল প্রকাশনার বিকাশ সাধন এবং সৃজনশীল প্রকাশকদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রসার এবং প্রকাশনার পেশাদারিত্ব জোরদার করা। সৃজনশীল প্রকাশনার অন্তরায়সমূহ চিহ্নিত করে তা অপসারণে সচেষ্ট হও। দেশে পাঠ প্রবণতা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন এবং ইউনেস্কো উল্লিখিত রিডিং সোসাইটি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হওয়া। কপিরাইট বিধি প্রচলনে সহায়তা করা।
বলা হয়ে থাকে যে, নতুন গঠিত এই সমিতি সৃজনশীল প্রকাশকদের স্বার্থ সংরক্ষণে স্বাতন্ত্র্যভাবে কাজ করে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন রয়ে যায় এমন যে, উক্ত সমিতি সৃজনশীল প্রকাশকদের স্বার্থ কতটুকু সংরক্ষন করতে পেরেছে, যদি না পারে তবে সেই ব্যার্থতার দায় তারা নিবে কিনা বা নেওয়ার সামর্থ্য আছে কি? আরেকটি প্রশ্ন সামনে এসে পরে যে নতুন এই সংগঠন কত টুকু স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখেছে, সে কি আদো স্বাতন্ত্র্য কিনা? যদি না থাকে তবে এর দায় প্রকাশকদের উপর বর্তায় কিনা? বা প্রকাশকগণ তাদের এই বক্তব্য মেনে নিবে কিনা? অন্যদিকে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রকাশনা ও মুদ্রণে উল্লেখযগ্য কোন অবদান রাখতে পারে নি, সে যদি অবদান রাখতে পারত তবে সৃজনশীল প্রকাশনার উন্নয়ন সম্ভব ছিল। ফিরে দেখা যাক তার দায়িত্ব এবং কর্তব্যের খতিয়ান -পুস্তক প্রকাশনা ও বিপণনের উন্নয়ন করা। জনসাধারণের মধ্যে অধিক ও ব্যাপক হারে পাঠ প্রবণতা ও আগ্রহ সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি করা। শিল্পসম্মত উন্নতমানের পুস্তক মুদ্রণে উৎসাহিত করার ফলে শ্রেষ্ঠ মুদ্রাকরকে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা। পুস্তক প্রকাশনাবিষয়ক জাতীয় এবং সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে আন্তর্জাতিক সেমিনার সম্মেলন, কর্মশালা, বইমেলার আয়োজন ও পরিচালনা করা।
যত সামান্য উন্নয়ন সে করলেও সেই উন্নয়ন কিন্তু উল্লেখ করার মত না। সে এক্ষেত্রে সম্পুর্ন ব্যার্থতার পরিচয় দিয়েছে। কেন জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র ব্যার্থ হল ? এর পেছনে কারণ কি ছিল? এই ব্যার্থতার পেছনে দায় কাদের? রাষ্ট্র নাকি প্রকাশকদের? সেই প্রশ্নে উত্তরগুলো ঘাটলে দেখা যায়-
সিন্ডিকেট সমস্যা- সমিতি হয়েছে, আবার নতুন সমিতির জন্মও হয়েছে, সরকারি সংস্থাও গঠিত হয়েছে, তারপর ও প্রকাশক ও প্রকাশনা জগত এক অদৃশ্য সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি, সিন্ডিকেট সংকট দুই মুখি। ছোট কিন্তু সৃজনশীল প্রকাশনী যাদের ইচ্ছা পাঠককে কিছু ভাল বই উপহার দেবার, কিন্তু পুঁজির কাছে হেরে যাচ্ছে তাদেরকে বাধ্য হয়ে সিন্ডিকেটে যেতে হচ্ছে। বাজারে একচেটিয়া ব্যাবসা করার নিমিত্তে সে ছোট ছোট প্রকাশনীকে বাধ্য করে তাদের সাথে যুক্ত হতে। ভর্তুকির অপ্রতুলতা- বলা হয়ে থাকে যে , বাংলা একাডেমিতে নিবন্ধিত প্রকাশনা সংস্থা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুবিধা লাভ করে থাকে, মেলা শেষে অবিক্রত বই বাংলা একাডেমি মারফত সরকার কিনে নেয়, এবং সে অনুজায়ি মূল্য দিয়ে থাকে, কিন্তু যে সমস্ত প্রকাশন সংস্থা নিবন্ধনের বাইরে তারা বরাবরের মত কোন ভুর্তুকি পায় না, আবার যে যৎসামান্য ভুর্তুকি আসে তাও উচ্চ স্তরের প্রকাশকগন নিজেদের মধ্যে ভাগভাটোয়ারা করে নেন, ফলে এক্ষেত্রে ছোট প্রকাশক এখানে কোন সুবিধা লাভ করে না। প্রকাশনা শিল্প আজো সরকারি মর্যাদা লাভ করে নি, অর্থাৎ এটি পাকিস্তান আমল থেকে এখনো সরকার স্বীকৃত কোন শিল্প হতে পারেনি। যার দরুন এই শিল্পের জন্য সরকার কোন প্রকার সু-নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। প্রকাশনা শিল্পে বিশেষ করে শ্রমিকদের মুজুরি প্রদান এক প্রকার উপেক্ষিত থেকে গেছে, যেখানে প্রকাশকের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক সেখানে শ্রমিক বান্ধব শিল্প আশা করা মানে বোকার স্বর্গে বসবাস করার শামিল। অধিকাংশ চিত্রে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র বি-মেলাকে সামনে রেখে যে কর্মযজ্ঞ চলে তাতে কিছুটা শ্রমিকের চাহিদা বাড়ে, তাছাড়া সারা বছর সল্প সংখ্যক শ্রমিকের উপর নির্ভর করতে হয়। বাইরের বিশ্বে প্রকাশকদের আলাদা প্লাটফর্ম থাকে, সেখানে এই দেশের প্রকাশনা শিল্পের উল্লেখ করার মতো কোন প্লাটফর্ম নেই বললেই চলে। বরাবরের মতো পুঁজি আসবে কোথা থেকে বা পুঁজির উৎস কোথায় এমন প্রশ্ন প্রকাশকদের মাথায় ঘুরপাক খেতে দেখা যায়, অথচ তারা ক্রাউডফান্ডিং এর ব্যাপারে সচেতন কিনা সে সন্দেহ থেকেই যায়, এই ক্রাউডফান্ডিং কে পুজির বড় উৎস হিসাবে গন্য করা হয়।
অদ্ভত বিষয় হচ্ছে বড় বড় ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান বিনা জামানতে কম সুদে ব্যাংক হতে লোন পেয়ে থাকে, এছাড়াও ব্যাবসা প্রসারের লক্ষ্যে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য এস.এম.ই লোন দিয়ে থাকে বা লোনের ব্যাবস্থা করে দেয়। গত মাসের ১২ তারিখ সরকার নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য স্টার্ট আপ ফান্ড গঠন করে। অথচ প্রকাশকদের ব্যাংক লোন দিতে অনীহা প্রকাশ করে বা তাদের লোন সুবিধা প্রদানের জন্য কোন ফান্ড আজো অব্দি গড়ে উঠে নি বা সরকারের এ বিষয়ে একদম নজর নাই বললে চলে, অনেকটা বিমাতা সুলভ আচরণ। প্রকাশনা শিল্প সব থেকে বেশি বাধার সম্মুক্ষীণ হয়েছে তার আমদানি শুল্কের অস্মতার কারনে, দেখা যায় যে অধিকাংশ পণ্য সল্প শুল্কে আমদানি করতে পারলেও প্রকাশকদের কাছ থেকে কাগজ আমদানির বেলায় অনেক বেশি শুল্ক আদায় করা হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে 'বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না' কথাটি সত্য সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু দুখের সাথে বলতে হয় যে মধ্যোবিত্ত শ্রেনির আজো বই পড়ার অভ্যাস এখনো সেভাবে গড়ে উঠেনি।তাই দেখা যায় যে একজন মধ্যোবিত্ত ব্যাক্তি মাসিক যে পরিমান অর্থ উপার্জন করে তার সামান্য পরিমান অর্থ সে বই কেনার পেছনে ব্যায় করে না, এখানেই বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। অদ্ভুত হলেও সত্য যে সমাজের সকল স্তরে বই পড়ার প্রচলন এখনো চালু হয় নি। প্রকাশনা শিল্পের আজকের এই দূর অবস্থার পেছনে কারন খতিয়ে দেখতে গেলে দেখা যায় যে, সে মানসম্মত লেখক তৈরি করতে ব্যার্থ। বই মেলা আসলে দেখা যায় যে, প্রকাশকেরা খদ্দের ধরতে ব্যাস্ত হয়ে পরে, তাদের কাছে লেখক নয় খদ্দের হল আসল।
অনেক সময় দেখা যায় সনামধন্য লেখকের অনুমতি না নিয়ে তার বই ছাপতে, ফলে আসল লেখকেরা তাদের প্রাপ্য রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত হন। রাষ্ট্র কর্তৃক পর্যাপ্ত বই না কেনার প্রবণতা দেখা যায়, এতে করে পাবলিক লাইব্রেরি গুলো মান সম্মত বই পায়না। সরকার প্রতি বছর পাবলিক লাইব্রেরির জন্য বই কেনা বাবদ যে বাজেট বরাদ্দ করে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। প্রতি বছর বই মেলা আসলে যেটা চোখে পরে তা হল মোসুমি প্রকাশকদের দোরাতব বেড়ে যায়, ফলে প্রকত প্রকাশক তাদের কাঙ্ক্ষিত ম্যুলায়ন থেকে বঞ্চিত হন। অধিকাংশ প্রকাশকদের মৌলিক জ্ঞানের অভাব লক্ষ্য করা যায়, আগে যেখানে প্রকাশকদের অনেকেই লেখক কিংবা সাহিত্যিক হতেন ফলে তারা মান সম্মত লেখার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে পারতেন। একটি যথাপযুক্ত পাণ্ডুলিপি পাঠককে আকৃষ্ট করে, সে বিষয়ে প্রকাশকদের নজর নেই বললেই চলে। অন্যান্য শিল্প অপেক্ষা প্রকাশনা শিল্পে অসম ট্যাক্স- ট্যারিফ পরিলক্ষিত হয়, এই অসমতার কারনেই এই শিল্প দিনদিন পিছিয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে আলোক পাত করা অবশ্যই কর্তব্য যে, প্রকাশকগন ব্যাবসায়িক মেন্টালিটি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সাহিত্যের যে নুন্যতম মান রাখা প্রয়োজন তা আর তারা ধরে রাখতে পারছে না।
পরিশেষে এটাই বলা যায় যে প্রকাশকদের সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাবসায়িক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই বললেই চলে, যার দরুন এই শিল্প দিনকে দিন পশ্চাৎ থেকে আরো পশ্চাতর হতে চলেছে। এর জন্য দায়ী যেমন প্রকাশকরা নিজেও আবার সরকারও সমানভাবে দায়ী
লেখক: স্নাতকোত্তর, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়