শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিরোনাম: দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস খাদে পড়ে নিহত ৪৫    মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা তৃণমূলে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান রাষ্ট্রপতির    মৎস খাতে বাংলাদেশকে ১৭২ কোটি টাকার অনুদান দিচ্ছে জাপান     আইসিসির এলিট প্যানেলে যুক্ত হলেন আম্পায়ার সৈকত    জেনে নিন আগামী পাঁচ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস    শুক্রবার নাগাদ আসতে পারে ভারতের পেঁয়াজ    বিএনপি স্বাধীনতার মর্মার্থকে অকার্যকর করতে চায়: কাদের   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
তারুণ্যের স্পর্ধিত কণ্ঠে ঘোষিত হয় স্বাধীনতার ইশতেহার
বিপুল হাসান
প্রকাশ: বুধবার, ৩ মার্চ, ২০২১, ৭:১৪ এএম আপডেট: ০৩.০৩.২০২১ ৭:৩৫ এএম | অনলাইন সংস্করণ

১৯৭১ সালের মার্চের প্রতিটি দিনই ছিল উত্তাল। একদিকে নির্বাচনে জিতে আসা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গড়িমসি, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশজুড়ে প্রতিরোধ-সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়  এই মার্চেই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন থেকে মুক্তিতে এ মাসেই বাঙালির হৃদয়ে দানা বাধতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্ন।

এদেশের শোষিত নিপীড়িত মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াই করে আসছিল। মহান ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল সেই ধারবাহিক লড়াইয়ের একেকটি মাইল ফলক।  

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৩ বছর পর ১৯৭০ সালে। সেই নির্বাচনের ফলাফল ছিল আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি জনগণের সমর্থন। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগেরই  সরকার গঠনের কথা ছিল। ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ায় জানুয়ারিতেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে পারত, কিন্তু সরকার ও পিপলস পার্টি-মুসলিম লীগ ষড়যন্ত্র করে পিছিয়ে দেয়। ৩ মার্চ অধিবেশন আহ্বান করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ তাতে আপত্তি করেনি, বরং অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু  আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন ইয়াহিয়া। মুহূর্তে গর্জে উঠে পুরো দেশ। মানুষ বুঝতে পারে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি নয়।  শ্লোগান ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ দিন সারাদেশে  আওয়ামী লীগের ডাকা হরতাল স্বতস্ফুর্তভাবে পালিত হয়। অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক ছাত্র–শ্রমিক সংগঠন হরতালে সমর্থন দেয়।  বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর অর্থাৎ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার দিনটিকে ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করা হয়।   এ দিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পরিবর্তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় পার্লামেন্টারি পার্টিগুলোর নেতাদের সঙ্গে এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।

৩ মার্চ বিকেলে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে  অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল ছাত্র জনসভা। এতে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তার উপস্থিতিতে  স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা  উত্তোলন করেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখেই তিনি পাঠ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার। এ ইশতেহারে বলা হয়- ‘৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গ মাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার সাত কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ।

ইশতোরে বলা হয় স্বাধীন দেশ গঠন করে  তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে:
১. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক শ্রমিক রাজনীতি কায়েম করতে হবে।
৩. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।

এতে  আরও বলা হয়, বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য গ্রহণ করতে হবে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা:
১. বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর, জেলায় `স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করতে হবে।
২. সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা ও তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
৩. শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সুসংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে।
৪. হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
৫. স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা এবং লুটতরাজসহ সকল প্রকার সমাজবিরোধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।

ইশতেহারে ঘোষিত স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাও  নির্দিষ্ট করা হয়:
১. বর্তমান সরকারকে বিদেশি উপনিবেশবাদী শোষক সরকার গণ্য করে এর ঘোষিত সকল আইনকে বেআইনী বিবেচনা করতে হবে।
২. তথাকথিত পাকিস্তানের স্বার্থের তল্পিবাহী পশ্চিমা অবাঙালি মিলিটারিকে বিদেশি ও হামলাকারী শত্রু সৈন্য হিসেবে গণ্য এবং এ হামলাকারী শত্রুসৈন্যকে খতম করতে হবে।
৩. বর্তমান বিদেশি উপনিবেশবাদী শোষক সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
৪. স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণরত যে কোনো শক্তিকে প্রতিরোধ, প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ ও খতম করার জন্য সকল প্রকার সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।
৫. বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
৬. কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার হবে।
৭. শোষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানি দ্রব্য বর্জন এবং সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
৮. উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে।
৯. স্বাধীনতা সংগ্রামরত বীর সেনানিদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।

একই সঙ্গে ওই সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে নিম্নলিখিত জয়ধ্বনি ব্যবহৃত হবে বলে উল্লেখ করা হয় ওই সভায়-   ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’,  ‘স্বাধীন কর স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’,  ‘স্বাধীন বাংলার মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’,  ‘গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, মুক্তিবাহিনী গঠন কর’, ‘মুক্তি যদি পেতে চাও, বাঙালিরা এক হও’।

ইশতেহারটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড করতালির মধ্যে প্রস্তাব গৃহীত হলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পল্টন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। প্রস্তাবটি লিখেছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন দফতর সম্পাদক এম এ রশীদ।

একাত্তরের ৩ মার্চের  ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুও ভাষণ দেন।  ওই ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন ৭ মার্চে রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাঠে তিনি আন্দোলনের বিস্তারিত কর্মসূচি জানাবেন।



বারুদের মতো এদেশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ায় বিচলিত বোধ করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে ওইদিনই পাকিস্তান সরকার জারি করে সান্ধ্য আইন। কিন্তু তা উপেক্ষা করেই অব্যাহত থাকে জনতার বিক্ষোভ ও মিছিল। কোনোভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে  রাখতে পারেনি পাকিস্তান সরকার। কারণ এরই মধ্যে  বাঙালি  স্বাধীনতার স্বপ্নমাখা পথে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে।



ভোরের পাতা- এনই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


আরও সংবাদ   বিষয়:  তারুণ্যের স্পর্ধিত কণ্ঠে   স্বাধীনতার ইশতেহার    বিপুল হাসান   ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ   







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]