ছয় বছর আগে বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার মামলায় সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়াসহ পাঁচ জঙ্গিকে মৃত্যুদন্ড এবং উগ্রপন্থি ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। গত মঙ্গলবার দুপুরে এই রায় দেন আদালত। রায় নিয়ে ভোরের পাতার সঙ্গে কথা হয় অভিজিৎ রায়ের ছোটোভাই অনুজিৎ রায়ের। শোকে বিহ্বল অনুজিৎ কিছুটা আতঙ্কিতও মূল অপরাধীরা ধরা না পড়ায়। রায় সম্পর্কে অনুজিৎ রায় ভোরের পাতাকে জানান, ‘অনেক আগেই এই রায় হওয়া উচিত ছিল। তবে এই রায়কে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতে এই কারণে দেখছি যে, অনেক দেরিতে হলেও বিচারের রায় ঘোষণা হয়েছে।’ ২০১৯ সালের ১ আগস্ট চার্জশিট গঠনের মাত্র ৩১ কর্মদিবসের মধ্যে শেষ হয়েছিল মামলাটির ট্রায়াল প্রক্রিয়া। বিচারপতিদের সামনে তাঁর বক্তব্য পেশও করেছিলেন অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়। যিনি ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রয়াত হন। শুনে যেতে পারেননি ছেলে অভিজিৎ হত্যা বিচারের রায়। বাবার বিষয়ে স্মৃতিচারণ করে অনুজিৎ রায় বলেন, ‘এই হত্যাকান্ডের এত বছর চলে গেল, আমার বাবা থানায় এফ আই আর করার পর কোর্টে উঠতে বছরের পর বছর চলে গিয়েছে। তা ছাড়া মামলাটি কোর্টে উঠতে দীর্ঘসূত্রতা কাজ করেছে। চার্জশিট আসতে দেরি হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাস হতে জটিলতার কারণে দেরি হয়েছে। তা ছাড়া এমন একটা সময় বাবাকে সাক্ষ্য দিতে হয়েছে যখন বাবা বয়সের ভারে শারীরিকভাবেও অসুস্থ ছিলেন। তাই, অনেক সময় অনীহা প্রকাশও করেছিলেন। সে কারণে ভিডিও কনফারেন্সে নেবার আবেদনও করেছিলেন। সেসময় আদালত ভিডিও কনফারেন্স ব্যবস্থা চালু না থাকায় শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সাক্ষী দিতে হয়েছে। বিচারের কাজটা বাবা দেখে যেতে পারলেন না। তারপরও আমি পুরোপুরি নেগেটিভলি দেখছি না। অভিজিৎ রায়ের ভাই হয়ে এবং অজয় রায়ের সন্তান হয়ে আমি রায়টা যেহেতু পেয়েছি...। তারপরও আমি পুরোটা সন্তুষ্ট নই, কারণ-এই হত্যাকান্ডের মূল যারা আসামি তাদের এখনো পুলিশ প্রশাসন গ্রেফতার করতে পারেনি। এখনো তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে আছে এবং যতক্ষণ তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পরিবারই শুধু নয় দেশের সবাই আতংকে থাকবে, নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে। এখন হয়ত তারা তাদের কৌশল পাল্টাতে পারে।’
দ্রুত রায় কার্যকর হবে এ আশা করে তিনি বলেন, ‘এই রায়ের পর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে উঠেপড়ে লাগতে পারে ঘাতকরা। এজন্য পুলিশ প্রশাসনের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ- যেভাবেই হোক তাদের অতিসত্বর গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক। তারপরও আমি মূল আসামিদের ধরা পড়ার বিষয়ে সন্দিহান। কিন্তু যারা ধরা পড়েছে তাদের বিচারটা ন্যায্য বিচার হয়েছে বলে আমি মনে করি। এ রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক-এবং আইনের ফাঁক গলে কোনো অপরাধী যেন বেরিয়ে যেতে না পারে সেটাই প্রত্যাশা করি।’
সাক্ষ্য দিতে অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের নাটকীয়তা করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আদালতে মামলা নিয়ে আমার বাবাকেও পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুলিশ ইনভেস্টিগেটর অফিসারও আমাদের বাসায় এসেছিল। আমার বাবার মৃত্যুর পরেও ওনার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে পুলিশ এসেছিল। তখন আমি বলেছিলাম, সাক্ষ্য দিতে তার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি শংকিত আছেন। পুলিশ অফিসাররা এরপরও যদি আমার কাছে যোগাযোগের নম্বর চাইতো কিংবা মেইল আইডি চাইতো, তাহলে আমি সেটা দিতাম অবশ্যই। তখনো আমি বলেছিলাম দরকার হলে আপনারা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন। কিন্তু বন্যাদি যে দেশে থাকেন সে দেশেও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা তখনও হয়নি। তখন হয়তো এই রিপোর্ট করা হয়েছে কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার আছে... বন্যাদি যেটা বলেছিলেন যে রাষ্ট্রপক্ষ নাকি বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস দিয়ে ওনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। বন্যাদির বক্তব্য ছিল-না, সেভাবে কেউ যোগাযোগ করেনি। পরে আমি বন্যাদিকে বললাম, এই ঘটনাগুলো। আর আমারও একটা ভুল হয়েছিল যে, পুলিশ ইনভেস্টিগেটর অফিসাররা যখন এসেছিল সেটা তাঁকে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু, ওই সময় কাজের ব্যস্ততার চাপেই হোক কিংবা বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে না পারার কারণেই হোক-আমি ওনাকে সেটা জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম। তারপরও বন্যাদি তার বক্তব্য জানিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষও কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই তার বক্তব্য নিতে পারত ওই সময়। কারণ, তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে যোগাযোগ করাটা কোনো ব্যাপার না। তা ছাড়া, অফিসাররা যদি আমার কাছে ইমেইল আইডিটা চাইতো আমি সেটা দিতে পারতাম। তারা যদি আগে যোগাযোগ করতো তাহলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।’
আদালত রায় দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এই বিচারের ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রকাশ পেয়েছে। এ বিষয়ে অনুজিৎ রায় ভোরের পাতাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ যদি একটি ধর্ম নিরেপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়, তাহলে দেশের মানুষ চাইলে ধর্ম মানতেও পারে, নাও মানতে পারে। সে যদি ধর্মের বিষয় লিখতে চায়, সে অধিকার যেমন তার আছে, তেমনি যে ধর্ম মানে না- এরকম মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও থাকতে হবে। ধর্ম নিরেপেক্ষতা মানে সব ধর্মবিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী অর্থাৎ আস্তিক-নাস্তিক সবার জন্যই দেশ।’
প্রধান আসামি মেজর জিয়ার বিষয়ে অনুজিৎ বলেন, ‘কাউন্টার টেররিজম ইউনিট থেকে বলা হয়েছে মেজর জিয়াকে ধরতে তার দেশের বাড়িসহ নানা জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। তারপরও এখনো প্রধান আসামির কাউকে পুলিশ প্রশাসন ধরতে পারেনি। আরেক আসামি ফারাবিকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফারাবি নিজেই অকপটে স্বীকার করেছে যে, সে খুন করেনি এবং হত্যাকান্ডে অংশ নেয়নি। তবে হত্যার হুমকি দিয়েছে। সে যে হুমকি দিয়েছে এবং নানাভাবে প্রকাশ্যে হত্যার প্ররোচনা দিয়েছে সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। কারণ আমার বড় ভাই যখন বেঁচে ছিল তখন কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আমার ভাইকে মেইল পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দিত ফারাবি। এখন সে হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে কি করেনি- এ বিষয়ে আমি বলব, যতই ফারাবি বলুক এই হত্যাকান্ডের বিষয়ে সে কিছু জানে না, সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য না, সে কিন্তু আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে সে সময় নানা তথ্য সরবরাহ করেছে। সে যেহেতু হত্যাকান্ডের বড় ভূমিকা রেখেছে এজন্য তারও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্য।