মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামীর একজন হলেন জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল ইসলাম (আগের নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সামরিক শাখার প্রধান সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া। দেশের বড় বড় প্রায় প্রায় প্রতিটি জঙ্গি তৎপরতায় তার সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিললেও গত সাত বছরেও তিনি কোথায় আছেন, তা শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
অভিজিৎ হত্যা মামলার রায়ের পর তার ছোটভাই অনুজিৎ রায় এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, রায় নিয়ে আমি সন্তুষ্ট হলেও আশঙ্কামুক্ত হতে পারিনি। হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়া রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। এই রায়ের পর তার নেতৃত্বে জঙ্গি গোষ্ঠী আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ ও আরও বেশি লোককে হত্যার চক্রান্ত করতে পারে। যেভাবেই হোক দ্রুত মেজর জিয়াকে গ্রেফতার করা দরকার।
অনুজিৎ রায়ের আশঙ্কা উপেক্ষা করার উপায় নেই। গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, জেএমবির সামরিক বাহিনীর প্রধান মেজর (বরখাস্তকৃত) জিয়াকে গ্রেফতার করা গেলেই দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কা কমে আসবে। তার অবস্থানের তথ্য প্রদানের জন্য পুলিশ ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করার পরও কোনো সাড়া মিলেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অভিজিৎ হত্যার সময় ঘটনাস্থলের ১০০ ফিট দূরেই ছিলেন জিয়া। সেখানে উপস্থিত থেকে পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন। অভিজিৎ হত্যা মামলার চার্জশিটেও বিষয়টির উল্লেখ ছিল। জঙ্গি নেতা মেজর জিয়ার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে দেশে থেকেই যোগাযোগ রাখতেন তিনি। এরপর থেকে কারো সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগের তথ্য নেই পুলিশের হাতে।
২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হায়দার খুনের পরই জিয়ার জঙ্গি অপতৎপরতার তথ্য পায় তদন্তকারীরা। পরে একে একে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন, ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নাজিমুদ্দিন সামাদ, নিলাদ্রী নিলয়, মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যা এবং প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় জিয়া সম্পৃক্ত বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তাঁর নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় ছোট স্লিপার সেলে বিভক্ত হয়ে হত্যার মিশনে নেমেছে, এমন অন্তত ৩০ জনের নাম পেয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তাদের অনেকে এরই মধ্যেই গ্রেপ্তার হলেও এখনো ‘রহস্যমানব’ হয়েই রয়ে গেলেন জিয়া।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশক দীপন হত্যা মামলায় জিয়াসহ আট জঙ্গিকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। আর যে লেখকের বই প্রকাশ করেছিলেন দীপন, সেই বিজ্ঞান বিশ্লেষক লেখক অভিজিৎ হত্যা মামলায় গতকাল মঙ্গলবার দেওয়া রায়ে জিয়াসহ পাঁচজনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অভিজিৎ হত্যা মামলায় জিয়াকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ২০১৯ সালের ৫ মে তাঁর সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন আদালত। গত ১২ জানুয়ারি ব্লগার নিলাদ্রী নিলয় হত্যা মামলায়ও পলাতক জিয়ার সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
সিটিটিসি ইউনিটের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, জিয়া এখনো পলাতক। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। সিটিটিসির উপকমিশনার (কাউন্টার টেররিজম) সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একাধিক মামলায় সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়ায় আমরা তাঁকে খুঁজছি।’
২০১৬ সালে গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার পর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করে সরকার। তবে গত কয়েক বছরে এই জঙ্গি নেতার অবস্থান জানাতে পারেনি পুলিশের জঙ্গি দমন ও তদন্তে নিয়োজিত ইউনিটগুলো। সর্বশেষ তথ্য মতে, ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠ, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, টেকনাফ-কক্সবাজার এলাকায় অবস্থান করে স্লিপার সেলের সমন্বয় করেন তিনি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি নিষ্ক্রিয় বলে দাবি করেছে একটি সূত্র।
তদন্তকারী সূত্র জানায়, জিয়া সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কর্মরত ছিলেন। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী এক সংবাদ সম্মেলনে সরকার উৎখাতে ধর্মান্ধ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নস্যাৎ করার খবর দেয়। সেই দলে থাকা জিয়া ঘটনার পরেই পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে একের পর এক ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক-প্রকাশক, বিদেশি নাগরিক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যার প্রেক্ষাপটে আবারও তাঁর নাম আলোচনায় আসে। একসময় নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) তাত্ত্বিক নেতা মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানির ঘনিষ্ঠ ছিলেন জিয়া। ২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হায়দার খুনের পর এবিটিতে জিয়ার কার্যক্রম প্রকাশ পায়।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, জিয়ার বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। তাঁদের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। পালানোর পর জিয়াকে ধরতে পটুয়াখালী শহরের সবুজবাগ এলাকায় তাঁর শ্বশুর মোখলেছুর রহমানের বাসায় দফায় দফায় অভিযান চালায় পুলিশ। তাঁর শাশুড়ি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা হামিদা বেগম সেই সময় গণমাধ্যমকে জানান, জিয়া পটুয়াখালীর বাসায় কখনো আসেননি। মৌলভীবাজারের গ্রামের বাড়িতে তাঁর যাতায়াতের তথ্যও নেই প্রশাসনের কাছে।
প্রসঙ্গত, মেজর জিয়ার নির্দেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গিরা পরপর খুন করে বেশ কজন মুক্তমনা মানুষকে। এই তালিকায় রয়েছেন- ১. বাংলাদেশের প্রথম সমকামী পত্রিকার পরিচালক সম্পাদক জুলহাজ মান্নান। ২. জুলহাজের সহযোগী তনয় মজুমদার। ৩. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিক। ৪. বগুড়ার গণিত শিক্ষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবু। ৫.সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক জগৎজ্যোতি তালুকদার। ৬.জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র এবং উদারপন্থী ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদ। ৭.জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপন। ৮. ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। ৯.নাস্তিক ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস। ১০.ওয়াশিকুর রহমান। ১১.অভিজিৎ রায়।১২. নাস্তিক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দর। ১৩.রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শফিউল ইসলাম৷ ১৪.মুন্সিগঞ্জের কমিউনিস্ট নেতা তথা মুক্তচিন্তার লেখক বিশাখা প্রকাশনীর কর্ণধার শাহজাহান বাচ্চু।