কুয়েতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের দায়ে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির আদালত। গত বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) এই রায়ের পাশাপাশি কুয়েতের ফৌজদারি আদালতের বিচারক আব্দুল্লাহ আল ওসমান পাপুলকে ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার জরিমানাও করেছেন। ইতিমধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও দণ্ডিত আসামি হিসাবে এমপি পাপুলের পক্ষে কোনো ধরণের সরকারি সহায়তা দেয়া হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. আবুল কালাম আব্দুল মোমেন। কুয়েতে দণ্ডিত হওয়ার ঘটনার জেরে হঠাৎ টাকার ক্ষমতায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি বনে যাওয়া পাপুলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ায়ের শেষ দেখে ফেলেছেন অনেকেই। এমপি পাপুলের রাজনৈতিক উত্থান পতনের নেপথ্য কাহিনী নিয়ে ভোরের পাতার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ভোরের পাতাকে জানান, তারা জানতে পেরেছেন পাপুলের বিরুদ্ধে কুয়েতের আদালতের চলমান তিনটি মামলার একটিতে ৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে, কুয়েতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ ও তার প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে কুয়েতি কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মামলায় তার কারাদণ্ড ও জরিমানা হয়েছে। মানবপাচার ও অর্থ পাচারের অপর দুটি মামলার শুনানি এখনও চলমান বলে জানান তিনি।
এদিকে ভোরের পাতার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। এমপি হওয়ার আগে থেকেই আলোচনায় আসেন লক্ষীপুর ২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুল। টাকার জোরে রাজনৈতিক মাঠে এই অতিথি পাখি নিজে এমপি বনে যাওয়ার পরই স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে এমপি বানানোর মিশনে নামেন। সেখানেও তিনি আলাদিনের চেরাগের কেরামতিতে সফল হন। স্বতন্ত্র কোটায় সংরক্ষিত নারী এমপি বনে যান সেলিনা ইসলাম। স্বামী-স্ত্রী দুজনই একাদশ সংসদের এমপি বনে যাওয়ার পর সমালোচনাও কম হয়নি। তবুও দমে যাননি পাপুল এবং তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। এবার স্বপ্ন ছিল লক্ষীপুরের রায়পুর পৌরসভায় নিজেদের সন্তান ওয়াফা ইসলামকে পৌর মেয়র বানানোর। সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন এমপি দম্পত্তি। যদিও রায়পুর পৌরসভায় নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন তৃণমূল বিচ্ছিন্ন গিয়াস উদ্দিন রুবেল বাট। তার সাথে তৃণমূল আওয়ামী লীগের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেছেন রায়পুর পৌরসভার স্থানীয় অধিকাংশ ভোটাররা।
মেয়েকে পৌর মেয়র পদে বসানোর আগেই কুয়েতে গিয়ে মানবপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন এমপি শহিদ ইসলাম পাপুল গত বছরের জুন মাসে। তারপর আইনী প্রক্রিয়ায় এসে গত ২৮ জানুয়ারি একটি মামলায় দণ্ডিত হন। এ কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে করেন প্রবাসীরা।
তবে, রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট অপরিপক্কতার পরিচয় দেয়া এমপি পাপুলের পুরো ক্যারিয়ারই এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ সবের মূলে যে ইস্যুটি কাজ করেছে তা হচ্ছে এমপি পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলামের অতিলোভ। বিষয়টি ভোরের পাতাকে নিশ্চিত করেই তার পরিবারের একটি বিশস্ত সূত্র বলেছে, বিয়ের পর থেকেই এমপি পাপুলের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন অতিলোভী সেলিনা ইসলাম। তার বুদ্ধিতেই রাজনীতিতে আসেন পাপুল। স্ত্রীর মন রক্ষা করতে গিয়ে সেলিনা ইসলামকেও এমপি বানান। এমনকি এমপি নিজের পরিবারকে তেমনভাবে না দেখলেও শ্বশুড়বাড়ির লোকজনকে অনেকটা বাধ্য হয়েই পালতে হয়েছে। নিজের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের একাউন্টেই ৫০০ কোটি টাকার লেনদেনের খবর গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। এমপি পাপুল নিজের মা-বোন-ভাইদের চেয়ে স্ত্রী এবং শ্যালিকাকেই প্রধান্য দিয়েছেন বিয়ের পর থেকে। আর সেই সুযোগে নিজের অতিলোভ চরিচার্থ করে সংরক্ষিত এমপি ঠিকই হয়েছেন সেলিনা, কিন্তু স্বামীকে কোনো সৎ পরামর্শ না দিয়ে শুধু টাকা আর ক্ষমতার পিছনে দৌঁড়াতে বলায় আজ পাপুলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ এবং এখন জেলখানায় বন্দি আছেন।
এমপি পাপুলের এক বাল্যবন্ধু ভোরের পাতার এ প্রতিবেদককে বলেছেন, পাপুল মানুষ হিসাবে চমৎকার। তিনি সহজ সরল ব্যবসায়ী মানুষ। তাকে রাজনীতির মাঠে নামিয়েছে স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। এখন নিজে এমপি আছেন, কিন্তু তার স্বামী কুয়েতের জেলখানায়। স্ত্রীর অতিলোভের কারণেই এমপি পাপুলের জীবনে এই দুরাবস্থা বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে, অতিলোভী এমপি সেলিনা ইসলামের সাথে টেলিফোনে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, আমার স্বামী কোনো অন্যায় করেনি। ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই আমার স্বামীর টাকা খেয়েছেন। তারা বিপদের সময় কেউই পাশে নেই। মিডিয়ার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে সেলিনা ইসলাম আরো বলেন, বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে জনশক্তি রপ্তানি করে আমার স্বামী পাপুল কোনো ধরনের ভুল করেননি। আমাদের যত টাকা আছে সবই তো এখন প্রকাশ্যে এসেছে। মিডিয়ার লোকজন শুধু আমাদের নেতিবাচক দিকগুলোই তুলে ধরছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। অতিলোভের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো জবাব দেননি।