প্রকাশ: রোববার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২১, ৬:৪০ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ৩০ হাজার সদস্যের বসবাস। শত শত বছর ধরে ঐতিহ্য ধরে রেখে তারা নিজেরাই নিজেদের পোশাক তৈরি করতেন। নিজ হাতে তাঁতে বুনতেন দক শাড়ি, দক মান্দা, ওড়না, গামছা, লুঙ্গি, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড়। কিন্তু সুতার মূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট, জীবন-জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় চলে যাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতায় এ এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর, বিশেষ করে গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের তাঁতশিল্প এখন হারিয়ে গেছে। গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের বাড়িগুলোতে কাঠের তাঁত এখন ঘুণে খাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, একসময় গারো পাহাড়ের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লিতে দিন-রাত এসব তাঁতের খটখট আওয়াজ শোনা যেতো। তবে এখন সে শব্দ তো দূরের কথা, তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগর ও তাঁতের কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই যায় না। এখন পড়ে থাকতে দেখা যায় তাঁত শিল্পের মেশিনগুলো। গত প্রায় এক দশক ধরে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছে এই শিল্প। গারো পাহাড় এলাকার গারো, কোচ, ডালু, বানাই, হদি, বর্মণসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ একসময় নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিজেরাই তৈরি করে ব্যবহার করতেন। যাদের তাঁত ছিল না তারা গ্রামের অন্যদের তাঁতের তৈরি করা বিভিন্ন ধরনের কাপড় কিনে ব্যবহার করত। কিন্তু এখন সেই ঐতিহ্য আর নেই। ফলে বাজারে প্রচলিত আর সব পোশাক ও অন্যান্য কাপড় কিনতে বাধ্য হচ্ছেন গারো আদিবাসীরা।
শেরপুরের গারো পাহাড় এলাকার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনও তাদের এ ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন সরকারের বিশেষ উদ্যোগ। এ শিল্পের কারিগররা যারা অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন, তাদের প্রণোদনা দিয়ে ফিরিয়ে এনে এই শিল্প পুনরুদ্ধার করতে হবে।
ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া কোচপাড়ার জাগেন্দ্র কোচ বলেন, ‘আট বছর আগে আমার আটটি তাঁত ছিল। আমরা গামছা, লুঙ্গি, নারীদের ওড়না, শাড়ি, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোশাক তৈরি করতাম। কিন্তু সুতার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমাদের অনেক খরচ পড়ে যায়। শ্রমিকরাও তাদের যথাযথ মজুরি না পেয়ে জীবনের তাগিদে অন্য পেশায় চলে যান। আবার টেক্সটাইলের শাড়ি-লুঙ্গির দাম অনেক কম থাকায় আমাদের গোত্রের লোকজন সেই পোশাকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে আমাদের এ তাঁত আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।’ জীবিকার তাগিদে খরচ বাঁচাতে তাঁত বন্ধ করতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
একই গ্রামের তাঁত শ্রমিক প্রণব কোচ বলেন, ‘আমি ঢাকায় একটি হোটেলে বাবুর্চির চাকরি করছি। এলাকার তাঁতগুলো আবারও চালু হলে ঢাকায় আর থাকবো না।’ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী রায়তি কোচ বলেন, ‘আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী দক শাড়ি পরা বাদ দিয়ে বাঙালিদের শাড়ি পরতে বাধ্য হয়েছি। এখন আবার এ তাঁত চালু হলে আমাদের ভালো হতো।’
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোচ নেতা যোগেন কোচ বলেন, ‘আমাদের ঐতিহ্যের তাঁত ও পোশাক রক্ষায় একসময় কারিতাস কিছু সহযোগিতা করলেও এখন আর কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। তবে সরকার থেকে কোনও সহযোগিতা পেলে আবার আমাদের এ ঐতিহ্য ফিরে আসতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের পার্বত্য এলাকার চাকমা ও মণিপুরি তাঁত সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার সহযোগিতায় বিলুপ্তের হাত থেকে বেঁচে উঠেছে। আমরাও চাই আমাদের শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতি সরকারি-বেসরকারি কোনও সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।’
এ বিষয়ে শেরপুর বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তা এসএম রেজুয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীদের ঐতিহ্য ও তাঁতশিল্পের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করবো। তারা যদি তাদের এ শিল্পকে রক্ষায় আমাদের কাছে আসে তাহলে আমরা বিপণন ও ঋণ সহায়তা দিতে পারবো।’